বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষা সবসময়ই একটি বড় অংশ দখল করে আছে। আলিয়া মাদ্রাসার ফাজিল ডিগ্রিকে ১৯৭৯ সালে এইচএসসির সমমর্যাদা দেয়া হলেও দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগে (যেমন: ইংরেজি, বাংলা, আইন, সাংবাদিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতেন তারা। মূল কারণ হিসেবে দেখানো হতো আলিয়া মাদ্রাসায় ২০০ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজি না থাকার অজুহাত।
তবে ২০১৫ সালে মাদ্রাসা শিক্ষায় ২০০ নম্বরের বাংলা ও ইংরেজি যুক্ত করা হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এরপর থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান। ফলস্বরূপ দেখা যায়, ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় শীর্ষস্থান অর্জন করছেন বিপুল সংখ্যক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী।
ঢাবিতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের আধিপত্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা শুধু একাডেমিক ক্ষেত্রে নয়, নেতৃত্ব ও রাজনীতিতেও নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। অনেকে বলেন, ঢাবি এখন “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসা”তে রূপ নিয়েছে। যদিও এটি সমালোচনামূলকভাবে বলা হলেও বাস্তবে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের শক্ত অবস্থান অস্বীকার করার উপায় নেই।
এর সাম্প্রতিক প্রমাণ পাওয়া গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে। এবারের নির্বাচনে প্রধান ছাত্রসংগঠনগুলোর ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) ও জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বেশিরভাগই মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থী।
ডাকসু নির্বাচনে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রভাব
চমকপ্রদ কিছু উদাহরণ নিচে তুলে ধরা হলো—
- জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (বিএনপি সমর্থিত):
ভিপি পদপ্রার্থী আবদুর রহমান খান, তিনি তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র। বর্তমানে ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যয়ন করছেন। - গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাকছাস):
ভিপি পদপ্রার্থী আবদুল কাদের, লক্ষ্মীপুরের যাদইয়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থী। বর্তমানে ঢাবির আইন বিভাগে অধ্যয়নরত। - ইসলামী ছাত্রশিবির:
- ভিপি পদপ্রার্থী সাদিক করিম, খাগড়াছড়ির বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে আলিম শেষ করেন চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসায়। বর্তমানে ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ছেন।
- জিএস পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদ, চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র।
- জাতীয় বিপ্লবী ছাত্র পরিষদ:
ভিপি প্রার্থী আবদুল ওয়াহেদ—মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের। - ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই):
ভিপি প্রার্থী জামাল উদ্দিন—মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ছিলেন। - গণ অধিকার পরিষদ:
ভিপি প্রার্থী বিন ইয়ামিন মোল্লা—মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন।
এই তালিকা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে প্রভাবশালী কয়েকটি প্যানেলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরাই।
কেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসছেন?
১. মেধার স্বীকৃতি:
দীর্ঘদিন বঞ্চিত হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছেন, সুযোগ পেলে তারা দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম।
২. ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্য:
বাংলা ও ইংরেজি সংযুক্ত হওয়ার পর ভর্তি পরীক্ষার প্রায় সব ইউনিটেই মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা শীর্ষ মেধাতালিকায় স্থান পাচ্ছেন।
৩. সংগঠিত শক্তি:
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সাধারণত ধর্মীয় মূল্যবোধে ঐক্যবদ্ধ থাকেন, যা তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
৪. সামাজিক বাস্তবতা:
বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার বিস্তৃতি ব্যাপক। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করলে নেতৃত্বে তাদের প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
বাম ও সেক্যুলার শিক্ষকদের উদ্বেগ
ঢাবিতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে বাম ও আওয়ামীপন্থি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের “সেক্যুলার চরিত্রকে” দুর্বল করে দেবে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন “মৌলবাদীদের দখলে” চলে যাচ্ছে।
তবে বাস্তবতা হলো কোনো শিক্ষার্থীকে কেবল তার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে বাদ দেয়া যায় না। যোগ্যতা থাকলে প্রতিটি শিক্ষার্থীই নেতৃত্বে আসার অধিকার রাখে।
উপসংহার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের উত্থান আজ আর অস্বীকার করার মতো নয়। ডাকসু নির্বাচনে তাদের শক্ত অবস্থান সেই প্রমাণই বহন করছে। একসময় যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় ঢুকতে বাধা দেয়া হতো, তারাই আজ নেতৃত্বের শীর্ষে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে এটি কোনো “মৌলবাদের দখল” নয়; বরং এটি হলো মেধা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি। সময়ই বলে দেবে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা কেবল রাজনীতিতেই নয়, দেশের ভবিষ্যত উন্নয়ন ও নেতৃত্বেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।