ডলার কীভাবে বিশ্ব শাসন করে? মুদ্রাস্ফীতি ও ফিয়াট কারেন্সির গোপন রহস্য

আপনি কি জানেন, আপনার পকেটের টাকা আসলে এক টুকরো ছাপানো কাগজ মাত্র? যার নিজের কোনো মূল্য নেই, মূল্য আছে কেবল আমাদের “বিশ্বাসে”। আমেরিকা কীভাবে শুধু ডলার ছাপিয়ে পুরো বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং কেন জিনিসের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে—এর পেছনের আসল কারণগুলো চমকে দেওয়ার মতো।

আজকের আর্টিকেলে আমরা যমুনা টিভির একটি বিশেষ প্রতিবেদনের আলোকে জানব ডলারের আধিপত্য, ফিয়াট কারেন্সি এবং বিশ্ব অর্থনীতির অজানা ইতিহাস।

ফিয়াট কারেন্সি আসলে কী?

 

সহজ কথায়, ফিয়াট কারেন্সি হলো এমন মুদ্রা যার নিজস্ব কোনো মূল্য (Intrinsic Value) নেই, কিন্তু সরকারের আদেশে তা বিনিময় মাধ্যম হিসেবে চলে। ভিডিওর তথ্যানুসারে, “Fiat” একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ “Let it be done” বা “এটি সম্পাদিত হোক”।

প্রাচীনকালে মানুষ পণ্য দিয়ে পণ্য বিনিময় করত (Barter System)। এরপর এল সোনা ও রুপার কয়েন, যার নিজস্ব মূল্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে কাগজের টাকা ব্যবহার করি, তা মূলত ঋণ বা ঋণের প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিনিময় প্রথা থেকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড

 

টাকার বিবর্তনের ইতিহাস বেশ রোমাঞ্চকর। ভিডিওতে উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো হলো:

  • বিনিময় প্রথা: শুরুতে মানুষ মাছের বদলে সবজি বা এক পণ্যের বদলে অন্য পণ্য নিত।

  • ধাতব মুদ্রা: সোনা বা রুপার কয়েন চালু হলো, যা ওজনে পরিমাপ করা যেত।

  • কাগজের নোট: স্বর্ণ বহন করা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় স্বর্ণকারের কাছে সোনা জমা রেখে রসিদ নেওয়া হতো, যা পরে কাগজের নোটে পরিণত হয়।

  • গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড: ১৯৪৪ সালের ‘ব্রেটন উডস’ সম্মেলনের পর ঠিক হয়, ডলারের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা জমা থাকবে। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমেরিকা এই নিয়ম ভেঙে দেয়।

ফেডারেল রিজার্ভ ও আধুনিক ব্যাংকিংয়ের জন্ম

 

ভিডিওর তথ্যানুসারে, ১৯১০ সালে জর্জিয়া দ্বীপের জেকিল আইল্যান্ডে এক গোপন মিটিং হয়, যেখানে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা “ফেডারেল রিজার্ভ”-এর খসড়া তৈরি হয়। ১৯১৩ সালে এটি পাস হয়।

এর ফলে ব্যাংকাররা টাকা ছাপানোর অসীম ক্ষমতা পেয়ে যায়। তারা চাইলেই কম্পিউটার স্ক্রিনে কিছু সংখ্যা টাইপ করে কোটি কোটি ডলার তৈরি করতে পারে, যার নাম “ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং”।

আমেরিকা কীভাবে ঋণ রপ্তানি করে?

 

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আমেরিকা তাদের ঋণ বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে। ভিডিওতে উল্লেখ করা হয়েছে:

  1. আমেরিকা নিজের প্রয়োজনে ডলার ছাপায়।

  2. সেই ডলার দিয়ে তারা বিদেশ থেকে পণ্য কেনে।

  3. বিনিময়ে তারা অন্য দেশকে দেয় কেবল কাগজের টুকরো (ডলার)।

এই অতিরিক্ত ডলার ছাপানোর ফলে বিশ্ববাজারে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর অর্থনীতির ধস নামার পেছনে এটিও একটি পরোক্ষ কারণ।

পেট্রোডলার (Petrodollar)

 

১৯৭১ সালে যখন ডলারের সাথে সোনার সম্পর্ক ছিন্ন হয়, তখন ডলারের মান ধরে রাখতে আমেরিকা এক নতুন চাল চালে। তারা সৌদি আরবের সাথে চুক্তি করে যে, তেল কিনতে হলে ডলারেই কিনতে হবে। একেই বলা হয় পেট্রোডলার সিস্টেম।

এর ফলে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে বাধ্য হয়ে ডলার রিজার্ভ করতে হয়। সাদ্দাম হোসেন বা গাদ্দাফির মতো শাসকরা যখন ডলারের বদলে ইউরো বা স্বর্ণমুদ্রায় তেল বিক্রির চেষ্টা করেছিলেন, তাদের পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ।

ডলারের বিকল্প কি আসছে?

 

বর্তমানে অনেক দেশ ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে বের হতে চাইছে। ভিডিওর বিশ্লেষণ অনুযায়ী:

  • রাশিয়া ও চীন: প্রচুর পরিমাণে সোনা মজুদ করছে।

  • BRICS: ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে ডলারের বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করছে।

  • ক্রিপ্টোকারেন্সি: বিটকয়েন বা ডিজিটাল কারেন্সি জনপ্রিয় হলেও সরকারগুলো নিজেদের ডিজিটাল মুদ্রা (CBDC) এনে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চাইছে।

সাধারণ মানুষের করণীয় কী?

 

অর্থনীতির এই জটিল সমীকরণে সাধারণ মানুষ বা মধ্যবিত্তরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন আমাদের জমানো টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তাই ভিডিওর পরামর্শ অনুযায়ী:

  • অর্থনৈতিক সাক্ষরতা (Financial Literacy) অর্জন করুন।

  • শুধুমাত্র ব্যাংকে টাকা ফেলে না রেখে সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ বা সম্পদ গড়ার চেষ্টা করুন।

  • পারিবারিক বাজেট ও সঞ্চয়ে সচেতন হোন।

সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

 

১. ফিয়াট কারেন্সি কেন ব্যবহার করা হয়?

উত্তর: এটি বহন করা সহজ এবং সরকার অর্থনীতির প্রয়োজনে এর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে অতিরিক্ত ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি হয়।

২. ডলারের দাম কেন বাড়ে?

উত্তর: বিশ্ববাণিজ্য ও তেলের লেনদেন ডলারে হওয়ায় এর চাহিদা সবসময় বেশি থাকে, তাই এর দাম বাড়ে।

৩. আমেরিকা কত ঋণগ্রস্ত?

উত্তর: ভিডিওর তথ্যমতে, আমেরিকার জাতীয় ঋণ প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার এবং মোট ঋণ ১০৫ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

উপসংহার:

টাকা বা ডলার শেষ পর্যন্ত একটি বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যেদিন এই বিশ্বাস টলে যাবে, সেদিন বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে। তাই ইতিহাসের এই শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top