মাযহাব কী? কেন মাযহাব মানা জরুরি?

বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের যুগে দ্বীনি বিষয় নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। বিশেষ করে “মাযহাব কী?”, “মাযহাব মানা কি জরুরি?” কিংবা “বিদআত ও সুফিবাদ নিয়ে সঠিক ধারণা কী?”—এই বিষয়গুলো নিয়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রায়ই বিতর্ক দেখা যায়।

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ড. শাদি আল-মাসরি এবং ‘টুওয়ার্ডস ইটারনিটি’-এর একটি বিশেষ আলোচনার আলোকে জানব মাযহাবের সঠিক সংজ্ঞা, এর প্রয়োজনীয়তা এবং আমাদের করণীয় সম্পর্কে।

মাযহাব আসলে কী?

 

অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে যে, মাযহাব হলো কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু বিষয়টি মোটেও এমন নয়।

মাযহাব হলো কুরআন ও সুন্নাহর বিধানগুলোকে সঠিকভাবে বোঝার এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর কথাগুলোর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে সাধারণ মানুষের জন্য জীবনযাপন সহজ করাই হলো মাযহাবের মূল উদ্দেশ্য। এটি কোনো নতুন ধর্ম নয়, বরং এটি ইসলাম পালনের একটি ‘মেথডলজি’ বা পদ্ধতি

মাযহাব কেন প্রয়োজন?

 

ভিডিওর আলোচনায় একটি চমৎকার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যা মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করে। খন্দকের যুদ্ধের সময় নবীজি (সা.) সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন:

“তোমরা বনু কুরাইজা গোত্রে না পৌঁছে কেউ আসরের নামাজ পড়বে না।”

এই নির্দেশ শুনে সাহাবীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেলেন:

১. প্রথম দল: তারা নবীজির (সা.) কথার আক্ষরিক অর্থ নিলেন এবং সূর্যাস্ত হয়ে যাওয়ার পরেও গন্তব্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত নামাজ পড়লেন না।

২. দ্বিতীয় দল: তারা ভাবলেন, নবীজির (সা.) উদ্দেশ্য ছিল ‘দ্রুত যাওয়া’, নামাজ কাজা করা নয়। তাই তারা পথেই নামাজ পড়ে নিলেন।

পরবর্তীতে নবীজি (সা.)-এর কাছে এই ঘটনা উপস্থাপন করা হলে তিনি দুটি মতকেই সঠিক বলে স্বীকৃতি দিলেন।

শিক্ষা: একই নির্দেশনার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে এবং উভয়টিই সঠিক হতে পারে। মুজতাহিদ ইমামগণ (যেমন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক) কুরআন-সুন্নাহর গভীর বিশ্লেষণের মাধ্যমে যে সমাধান দিয়েছেন, সেটাই মাযহাব।

ইসলামে মাযহাব ও ফিকহ শাস্ত্রের গুরুত্ব

 

কুরআনের আয়াত এবং হাদিস দুই ধরণের হয়:

  • সুস্পষ্ট বিধান: যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা। এগুলো বোঝার জন্য মাযহাব বা ফিকহ জানার প্রয়োজন নেই, সবাই জানে।

  • ব্যাখ্যাসাপেক্ষ বিধান: এমন অনেক আয়াত বা হাদিস আছে যার একাধিক অর্থ হতে পারে। সাধারণ মানুষের পক্ষে আরবি ব্যাকরণ ও গভীর জ্ঞান ছাড়া এর সঠিক মর্মার্থ উদ্ধার করা অসম্ভব।

এক্ষেত্রে ইমামগণ তাদের অগাধ পাণ্ডিত্য, সাহাবীদের সান্নিধ্য এবং আরবি ভাষার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আমাদের জন্য বিধানগুলো সহজ করে দিয়েছেন। মাযহাব আমাদের জীবনকে কঠিন করতে নয়, বরং সহজ করতেই এসেছে।

বিদআত ও সুফিবাদ

 

ভিডিওটিতে বিদআত এবং সুফিবাদ নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে।

১. বিদআত সম্পর্কে সঠিক ধারণা

 

অনেকে মনে করেন, ইসলামের পর আবিষ্কৃত সবকিছুই বিদআত এবং বর্জনীয়। কিন্তু শাফি ও মালিকি মাযহাবের ইমামদের মতে, সব নতুন বিষয়ই খারাপ বিদআত নয়। যেমন:

  • কুরআন সংকলন করে বই আকারে প্রকাশ করা।

  • তারাবির নামাজ জামাতে পড়া।

  • হাদিস শাস্ত্রের শ্রেণীবিন্যাস (সহীহ, যঈফ, হাসান)।

এগুলো নবীজির (সা.) যুগে ছিল না, কিন্তু এগুলো ইসলামের মঙ্গলের জন্য করা হয়েছে। তাই শরীয়তের মানদণ্ডে বিচার করেই কোনো কাজকে বিদআত বলা উচিত।

২. সুফিবাদ বা তাসাউফ

 

সুফিবাদ নিয়ে সমাজে অনেক বিতর্ক থাকলেও, এর মূল উদ্দেশ্য হলো ‘তাযকিয়াতুন নফস’ বা আত্মার পরিশুদ্ধি। ইসলামে ‘ইহসান’ অর্জনের যে কথা বলা হয়েছে, সুফিবাদ সেটাই চর্চা করে।

  • একজন সুফি হলেন তিনি, যিনি দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন।

  • তবে শর্ত হলো, তার আকিদা ও আমল অবশ্যই কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে। শরীয়ত বিরোধী কোনো কাজ সুফিবাদ হতে পারে না।

বর্তমান সময়ে মুসলিম উম্মাহর করণীয়

 

আজকের যুগে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ‘অনৈক্য’ বা দলাদলি। শয়তান চায় মুসলিমরা ছোটখাটো বিষয় (যেমন: মিলাদ, শবে মেরাজ পালন, হাত বাঁধার নিয়ম) নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকুক।

ভিডিওর শেষে আলোচক গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন:

  1. ঐক্য বজায় রাখা: ছোটখাটো মতভেদ নিয়ে ঝগড়া না করে মুসলিম হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকা।

  2. ঈমান যাচাই করা: বিজ্ঞানবাদ, নাস্তিকতা বা সেক্যুলারিজমের যুগে নিজের ঈমান ও বিশ্বাসকে মজবুত করা এখন ‘ফরজে আইন’-এর মতো জরুরি।

  3. আল্লাহর দিকে ফিরে আসা: আমরা যদি আল্লাহর দিকে ফিরে আসি, আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন এবং বিজয় দান করবেন।

সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন

 

প্রশ্ন: মাযহাব মানা কি ফরজ?

উত্তর: সাধারণ মানুষের জন্য, যারা সরাসরি কুরআন-হাদিস থেকে বিধান বের করতে অক্ষম, তাদের জন্য নির্ভরযোগ্য কোনো মাযহাব বা মুজতাহিদের অনুসরণ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক।

প্রশ্ন: চার মাযহাবের মধ্যে কোনটি সঠিক?

উত্তর: আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে, চারটি মাযহাবই (হানাফি, শাফি, মালিকি, হাম্বলি) সঠিক এবং হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত।

প্রশ্ন: বিদআত কত প্রকার?

উত্তর: কিছু আলেমের মতে বিদআতকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায় (ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরুহ, হারাম)। অর্থাৎ সব নতুন আবিষ্কারই নিষিদ্ধ বিদআত নয়।

উপসংহার

 

মাযহাব কোনো বিভক্তি সৃষ্টির জন্য আসেনি, এসেছে মুসলিমদের ইবাদত ও জীবনযাপন পদ্ধতিকে সুশৃঙ্খল ও সহজ করতে। আমাদের উচিত ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা এবং ছোটখাটো মতভেদ ভুলে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন।

আর্টিকেলটি ভালো লাগলে শেয়ার করে বন্ধুদের জানার সুযোগ করে দিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top