একসময় বলা হতো, জাপানি কোম্পানিগুলো যা তৈরি করে, বিশ্ব তা লুফে নেয়। ১৯৮০-র দশকে বিশ্বের শীর্ষ ৫০টি কোম্পানির মধ্যে ৩২টিই ছিল জাপানের। অথচ আজকের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। টয়োটা (Toyota) ছাড়া আর কোনো জাপানি কোম্পানি এখন বিশ্ববাজারে সেই দাপট দেখাতে পারছে না।
কিন্তু কেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে যে দেশ বিশ্ব অর্থনীতি শাসন করল, তারা আজ কেন ধুঁকছে? আজকের আর্টিকেলে আমরা জাপানের অর্থনীতির এই রোলার কোস্টার জার্নি এবং বর্তমান অবস্থার কারণগুলো বিশ্লেষণ করব।
জাপানের অর্থনৈতিক উত্থানের ইতিহাস
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান ছিল এক ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু সেখান থেকেই তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তাদের এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের পেছনে ছিল সুনির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা এবং সরকারি উদ্যোগ।
এমআইটিআই এবং সরকারি সহায়তা
জাপান সরকার গঠন করে ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়’ বা MITI। তাদের কাজ ছিল সম্ভাবনাময় খাতগুলো (যেমন: ইস্পাত, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল) খুঁজে বের করা এবং তাদের ঢালাওভাবে সাহায্য করা।
-
এফআইএলপি প্রোগ্রাম: সাধারণ নাগরিকদের সঞ্চয় ও পেনশনের টাকা কম সুদে কোম্পানিগুলোকে ঋণ হিসেবে দেওয়া হতো।
-
প্রযুক্তি আদান-প্রদান: বিদেশি কোম্পানিকে জাপানে ব্যবসা করতে হলে তাদের প্রযুক্তি শেয়ার করতে হতো, যা জাপানি কোম্পানিগুলো শিখে নিত।
সনি এবং ইনোভেশনের জোয়ার
জাপানের অর্থনৈতিক সাফল্যের অন্যতম প্রতীক ছিল সনি। আকিও মরিতা এবং মাসারু ইবুকার হাত ধরে সনি বিশ্ববাজারে রাজত্ব শুরু করে। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালে ওয়াকম্যান (Walkman) বাজারে আসার পর তা এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটায়। সনি হয়ে ওঠে জাপানের অর্থনৈতিক পুনর্জন্মের প্রতীক।
পতনের শুরু
১৯৮০-র দশকের শেষদিকে জাপানের হাতে প্রচুর অর্থ চলে আসে। কিন্তু এই অর্থ উৎপাদনশীল খাতে না গিয়ে চলে যায় রিয়েল এস্টেট বা জমিতে।
-
অবিশ্বাস্য জমির দাম: একসময় টোকিওর রিয়েল এস্টেটের দাম নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের চেয়ে ৩৫০ গুণ বেশি হয়ে গিয়েছিল।
-
বাবল বার্স্ট (Bubble Burst): ১৯৯০ সালের দিকে এই বাবল ফেটে যায়। জমির দাম কমতে শুরু করে এবং ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হতে থাকে। ১৯৯১ সালের মধ্যে জাপানে দেউলিয়া হওয়ার হার ৬৮.৫% বেড়ে যায়।
এই সময়কালকে জাপানের ইতিহাসে “লস্ট ডিকেড” (Lost Decade) বা হারানো দশক বলা হয়।
জাপানি কালচার যখন অর্থনীতির শত্রু
জাপানের সামাজিক কাঠামো একসময় তাদের শক্তি ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তা দুর্বলতায় পরিণত হয়।
আজীবন চাকরির নিশ্চয়তা
জাপানে “স্যালারিমান” কালচার ছিল খুব শক্তিশালী। একজন কর্মী এক কোম্পানিতেই সারা জীবন কাটাতেন। কোম্পানি তাদের পরিবারের মতো দেখত। কিন্তু মন্দার সময় যখন কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন হলো, তখন এই কালচার বাধা হয়ে দাঁড়াল। অদক্ষ ও বয়স্ক কর্মীদের বসিয়ে বেতন দিতে গিয়ে কোম্পানিগুলো নতুন ইনোভেশনে বিনিয়োগ করতে পারল না।
জম্বি কোম্পানি
সরকার দেউলিয়া কোম্পানিগুলোকে মরতে না দিয়ে লোন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করল। এগুলোকে বলা হয় ‘জম্বি কোম্পানি’। এরা নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারল না, আবার মরলও না—ফলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ল।
প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ার কারণ
জাপানের পতনের অন্যতম বড় কারণ হলো “গ্যালাপাগোস সিনড্রোম” (Galapagos Syndrome)। এর মানে হলো, বিশ্ববাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের দেশের জন্য প্রযুক্তি তৈরি করা।
-
সফটওয়্যার বনাম হার্ডওয়্যার: ২০০০ সালের পর বিশ্ব সফটওয়্যার ও ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু জাপান তখনো হার্ডওয়্যার (যেমন: ডিভিডি প্লেয়ার, উন্নত ইঞ্জিন) নিখুঁত করতে ব্যস্ত ছিল।
-
স্মার্টফোন বিপ্লব মিস করা: ২০০৫ সালেই জাপানে এমন ফোন ছিল যা দিয়ে পেমেন্ট ও টিভি দেখা যেত। কিন্তু তারা এই প্রযুক্তি বিশ্ববাজারে আনতে দেরি করে ফেলে। ঠিক সেই সময়ে অ্যাপল (iPhone) এসে বাজার দখল করে নেয়।
নেটফ্লিক্স যখন স্ট্রিমিং নিয়ে কাজ করছে, সনি তখনো ব্লু-রে ডিস্ক নিয়ে ব্যস্ত ছিল। টেসলা যখন গাড়িকে রোবট ভাবছে, জাপান তখনো ইঞ্জিন উন্নত করছে। এই দূরদর্শিতার অভাবেই শার্প বা তোশিবার মতো জায়ান্টরা হারিয়ে গেছে।
জাপানের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জাপান সরকার এখন পরিস্থিতি বদলাতে মরিয়া। ২০০০ সালে নেওয়া পরিকল্পনায় তারা সফল হয়নি। তবে সম্প্রতি তারা স্টার্টআপ ভিসা এবং নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
-
লক্ষ্য: ২০২৭ সালের মধ্যে ১০০টি ‘ইউ ইউনিকর্ন’ (১ বিলিয়ন ডলারের স্টার্টআপ) তৈরি করা।
-
বর্তমান: প্রায় ১০০,০০০ স্টার্টআপ এবং ৭-৮টি ইউনিকর্ন কোম্পানি তৈরি হয়েছে।
উপসংহার
জাপানের অর্থনীতি আমাদের শেখায় যে, সময়ের সাথে পরিবর্তন না হলে বিশাল সাম্রাজ্যও পতন হতে পারে। ইনোভেশন, ফ্লেক্সিবিলিটি এবং গ্লোবাল ট্রেন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই টিকে থাকার একমাত্র মন্ত্র। জাপান কি পারবে তাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে? উত্তর সময়ই দেবে।