দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে – তারা হলো আহমদিয়া মুসলিম জামা’আত, যারা সাধারণত ‘কাদিয়ানী’ নামে পরিচিত। এই বিতর্কের মূলে রয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম আহমদের ধর্মীয় দাবি এবং ইসলামের মৌলিক আকিদা (বিশ্বাস)-এর সাথে এর সংঘাত।
এই আর্টিকেলে মির্জা গোলাম আহমদ এবং তাঁর অনুসারীদের উৎপত্তি, মূল বিশ্বাস ও বিশ্বব্যাপী এই সম্প্রদায়ের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।
পরিচিতি ও নবুওয়তের দাবি
মির্জা গোলাম আহমদ ১৮৩৫ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামের নাম অনুসারে তাঁর অনুসারীদেরকে ‘কাদিয়ানী’ নামে অভিহিত করা হয়।
মূল দাবি ও আকিদা:
-
ওহী (ঐশী বাণী) প্রাপ্তির দাবি: ১৮৮৯ সালের ২৩ মার্চ মির্জা গোলাম আহমদ দাবি করেন যে তিনি খোদার কাছ থেকে ওহী পেতে শুরু করেছেন।
-
প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী ও মসীহ: তিনি নিজেকে শেষ জমানার প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী এবং প্রতিশ্রুত মসীহ (ঈসা/যীশু) উভয় হিসেবে ঘোষণা করেন।
-
উম্মতী নবী: গোলাম আহমদ নিজেকে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রদর্শিত পথে প্রেরিত একজন ‘উম্মতী নবী’ হিসেবে দাবি করেন। তাঁর কাজ নতুন শরিয়ত (আইন) নিয়ে আসা নয়, বরং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর শরিয়তের প্রচার করা।
উল্লেখ্য: মির্জা গোলাম আহমদ ও তাঁর বংশের লোকজন ব্রিটিশ শাসন আমলে ব্রিটিশদের অত্যন্ত অনুগত ও সেবাদানকারী ছিল।
মূল বিতর্ক: নবুওয়াতের সমাপ্তি ও মৌলিক পার্থক্য
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকিদা) অনুযায়ী, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) হলেন খাতামুন নাবিয়্যিন (নবীগণের শেষ বা নবুওয়তের সমাপ্তি)। অর্থাৎ, তাঁর পরে আর কোনো নতুন নবী বা রাসূল আসবেন না। এই বিশ্বাস ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
কাদিয়ানী/আহমদিয়াদের বিশ্বাস:
কাদিয়ানী অনুসারীরা ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ শব্দটির অর্থ গ্রহণ করে ভিন্নভাবে। তাদের মতে, এর অর্থ নবুওয়তের সমাপ্তি নয়, বরং এটি হলো ‘নবীগণের মোহর’ বা নবীগণের সত্যায়নকারী। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে তারা মির্জা গোলাম আহমদকে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পরে নবী হিসেবে দাবি করার বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে।
ঈসা (আঃ)-এর পুনরাগমন বিতর্ক:
সুন্নী আকিদা অনুযায়ী, ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ জীবিত অবস্থায় আসমানে তুলে নিয়েছেন এবং কিয়ামতের আগে তিনি আবার পৃথিবীতে আগমন করবেন।
কিন্তু মির্জা গোলাম আহমদ দাবি করেন, ঈসা (আঃ) স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তাঁর আর পুনর্জন্ম হবে না। বরং মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মতদের মধ্য থেকে কেউ একজন এই দায়িত্ব পালন করবেন, এবং গোলাম আহমদ নিজেকেই সেই দায়িত্বের জন্য নির্বাচিত দাবি করেন।
ইসলামের দৃষ্টিতে কাদিয়ানী
বিশ্বের সমস্ত ইসলামি পণ্ডিতদের ঐক্যমতে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে আল্লাহর শেষ নবী হিসেবে স্বীকার করা আবশ্যক। যদি কেউ তাঁকে শেষ নবী হিসেবে স্বীকার না করে এবং তাঁর পরে অন্য কোনো ব্যক্তিকে নবী বা রাসূল মনে করে, তবে সে আর মুসলিম থাকে না।
-
কাফের ঘোষণা: মির্জা গোলাম আহমদ নিজেকে নবী/রাসূল বা মসীহ হিসেবে দাবি করায়, সারা বিশ্বের সমস্ত ওলামায়ে কেরামের ঐক্যমতে গোলাম আহমদকে নবী বা রাসূল মনে করা ইসলাম থেকে খারিজ (বহিষ্কৃত) হওয়ার শামিল।
-
জিন্দিক (Heretic): ইসলামিক পণ্ডিতদের মতে, কাদিয়ানী অনুসারীরা সাধারণ কাফেরের চেয়েও জঘন্য, যাদেরকে ‘জিন্দিক’ বলা হয়। এরা এমন ব্যক্তি, যারা কুফরি বিশ্বাস ধারণ করে মানুষের সাথে প্রতারণা করে এবং মৌখিকভাবে নিজেদের মুসলিম দাবি করে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে কাদিয়ানীরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতেরও অন্তর্ভুক্ত নয়। তাদের এই আন্দোলনকে অনেকে একটি প্রতারণার ইতিহাস হিসেবে চিহ্নিত করেন, যা ১৯ শতকে খ্রিষ্টান মিশনারি ও আর্য সমাজবাদীদের ধর্মপ্রচারের সময় থেকেই শুরু হয়েছিল।
বিশ্বব্যাপী অবস্থান ও বাংলাদেশের কার্যক্রম
কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের নবুওয়তের দাবি বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলোতে ব্যাপক প্রতিরোধের শিকার হয়েছে।
-
বিশ্বব্যাপী অমুসলিম ঘোষণা: কাদিয়ানীদের প্রতারণার কারণে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সৌদি আরবের মতো বহু মুসলিম দেশে সরকারিভাবে তাদেরকে অমুসলিম বা কাফের হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সৌদি আরবে তাদের প্রবেশও নিষিদ্ধ।
-
সদর দপ্তর: মির্জা গোলাম আহমদের মৃত্যুর পর খেলাফত প্রথা প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে তাদের পঞ্চম খলিফা মির্জা মসরুর আহমদ লন্ডনের ফজল মসজিদ থেকে তাদের কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা তাদের বর্তমান সদর দপ্তর।
-
বাংলাদেশে কাদিয়ানী: উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বিশ্বের ২১১টি দেশে কাদিয়ানীদের কার্যক্রম চালু রয়েছে। বাংলাদেশেও তাদের ক্রমবর্ধমান কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়, যেখানে বর্তমানে তারা ১০৩টি শাখা এবং ৪২৫টি স্থানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
-
তাদের সবচেয়ে বেশি বসবাস পঞ্চগড়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, কুমিল্লা, জামালপুর, ময়মনসিংহ ও সুন্দরবন অঞ্চলে।
-
যদিও বাংলাদেশ সরকার এখনও আহমদিয়া মতবাদকে আনুষ্ঠানিকভাবে অমুসলিম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি, তবে এদেশের বিভিন্ন ইসলামি দল দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাফের ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে।
-
উপসংহার
মির্জা গোলাম আহমদের নবুওয়তের দাবি, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে শেষ নবী হিসেবে স্বীকার না করার কারণে, আহমদিয়া বা কাদিয়ানী সম্প্রদায় ইসলাম ধর্মের মৌলিক গণ্ডি থেকে বের হয়ে গেছে বলে বিশ্বের সমস্ত ইসলামি পণ্ডিত ও দেশের সরকার কর্তৃক ঘোষণা করা হয়েছে। এটি কেবল মাজহাবগত পার্থক্য নয়, বরং ইসলামের মূল আকিদার সাথে স্পষ্ট সংঘাতের ফল।