আপনি কি যানেন পৃথিবী কীভাবে মহাকাশে ভেসে থাকে এবং সূর্যের চারদিকে ঘোরে?
পৃথিবী মহাকাশে কীভাবে ভেসে আছে এবং কেন সূর্যের ভিতরে পড়ে যায় না এই প্রশ্নগুলো প্রায় সবার মনেই একবার না একবার এসেছে। আপনি কি জানেন যে পৃথিবী আসলে কিছুর উপরে ভেসে নেই, বরং মহাকাশের একটি বিশেষ বক্রতায় চলমান রয়েছে? চলুন বিজ্ঞানসম্মতভাবে এই রহস্য উন্মোচন করি।
পৃথিবী কি সত্যিই ভেসে আছে?
মহাকাশে পৃথিবীর নিচে কোনো কিছু নেই—একদম ফাঁকা অনন্ত শূন্যতা। তবে পৃথিবী পড়ে যাচ্ছে না কারণ এটি মাধ্যাকর্ষণ ও গতির একটি নিখুঁত সমন্বয়ে সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করছে।
পৃথিবীর দুই ধরনের গতি রয়েছে:
আহ্নিক গতি: পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘোরে, যার ফলে দিন ও রাত হয়।
বার্ষিক গতি: পৃথিবী সূর্যের চারদিকে প্রায় ৩৬৫ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে, যার ফলে এক বছর সম্পূর্ণ হয়।
সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ কীভাবে পৃথিবীকে ধরে রাখে?
সৌরজগতের সকল গ্রহ সূর্যের বিশাল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে সূর্যের চারদিকে চক্কর কাটে। সূর্যের ভর অত্যন্ত বেশি হওয়ায় এটি একটি শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি করে, যা হেলিওস্ফিয়ার অঞ্চল নামে পরিচিত।
আইনস্টাইনের জেনারেল রিলেটিভিটি থিওরি
মহান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তার জেনারেল রিলেটিভিটি থিওরিতে ব্যাখ্যা করেছেন যে মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ কীভাবে কাজ করে।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী:
- মহাকাশ একটি বিশাল চাদরের মতো, যাকে স্পেস-টাইম বলা হয়
- সূর্যের মতো ভারী বস্তু এই চাদরে একটি বক্রতা বা গর্ত সৃষ্টি করে
- এই বক্রতার কারণেই ছোট গ্রহগুলো সূর্যের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং তার চারদিকে ঘুরতে থাকে
সূর্য স্পেস-টাইমকে বাঁকিয়ে দেয়, এবং পৃথিবী সেই বাঁকা পথে চলতে থাকে—ঠিক যেমন একটি মার্বেল বোলিং বলের চারদিকে ঘুরতে থাকে।
পৃথিবী সূর্যের ভিতরে পড়ে যায় না কেন?
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মাধ্যাকর্ষণ যদি পৃথিবীকে সূর্যের দিকে টানছে, তাহলে পৃথিবী সূর্যে গিয়ে পড়ে না কেন?
গতি এবং মাধ্যাকর্ষণের ভারসাম্য
উত্তরটি লুকিয়ে আছে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতিতে:
১. সূর্য গোলাকার এবং পৃথিবীর প্রদক্ষিণ গতি অত্যন্ত দ্রুত ২. পৃথিবী যখন সূর্যের একটি কার্ভেচার পয়েন্ট থেকে অন্য পয়েন্টে পৌঁছায়, সূর্যের গোলাকার বক্রতার কারণে এটি সূর্যের দিকে নামতে থাকে ৩. কিন্তু পৃথিবীর নিজস্ব গতি এটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় ৪. ফলে পৃথিবী ক্রমাগত সূর্যের গোল কক্ষপথে ঘুরতে থাকে, কখনো সূর্যে পড়ে না
এটি অনেকটা এমন যে, আপনি যদি একটি বলকে দ্রুত গতিতে সামনের দিকে ছুড়ে দেন, তাহলে মাধ্যাকর্ষণ এটিকে নিচে টানলেও বলটি একটি বক্র পথ তৈরি করে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই বক্র পথটি বৃত্তাকার এবং অবিরাম।
কৃত্রিম উপগ্রহ কীভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে?
একই নীতি কৃত্রিম স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে থাকা উপগ্রহগুলো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না কারণ:
- পৃথিবী গোলাকার
- স্যাটেলাইটগুলো ক্রমাগত পৃথিবীর গোলাকার পৃষ্ঠতলের দিকে নামতে থাকে
- পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তাদের পৃথিবীর সাথে যুক্ত রাখে
- তাদের গতি তাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়
এভাবেই একটি নিখুঁত কক্ষপথ তৈরি হয়।
স্পেস-টাইম কার্ভেচার
আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুসারে, স্পেস-টাইমে থাকা যেকোনো বস্তু স্পেসকে সামান্য বাঁকিয়ে দেয় এবং নিজের কিছু দূরত্বের মধ্যে একটি মহাকর্ষীয় অঞ্চল তৈরি করে।
যখন কোনো ছোট বস্তু এই অঞ্চলে প্রবেশ করে, তখন:
- বড় বস্তুর সৃষ্ট বক্রতা অনুসরণ করে
- বড় বস্তুর চারদিকে চক্কর কাটতে থাকে
- পর্যাপ্ত গতি থাকলে কক্ষপথে স্থিতিশীল থাকে
পৃথিবী এবং সূর্যের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই ঘটেছে। পৃথিবী সূর্যের স্পেস-টাইম কার্ভেচার এলাকায় এসেছে এবং সেই বক্রতায় ঘুরছে।
পৃথিবী যদি সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে যেত?
যদি কোনোভাবে সূর্য হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে:
- পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে সরে যাবে
- সোজা রেখায় অনন্ত মহাকাশে ভেসে যেতে থাকবে
- আর কোনো নির্দিষ্ট কক্ষপথ থাকবে না
এটিই প্রমাণ করে যে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ এবং পৃথিবীর গতির সমন্বয়ই পৃথিবীকে তার কক্ষপথে রাখে।
এই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট যে, পৃথিবী কোনো রহস্যজনক শক্তিতে ভেসে নেই, বরং পদার্থবিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সূর্যের চারদিকে নিয়মিত প্রদক্ষিণ করছে। মাধ্যাকর্ষণ এবং গতির এই নিখুঁত সমন্বয়ই আমাদের পৃথিবীকে টিকিয়ে রেখেছে এবং জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব করেছে।