যুব এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে বাংলাদেশ

কখনো ভেবেছেন, একটা পদক শুধু ধাতব বস্তু নয়—এটা হতে পারে একটা জাতির স্বপ্ন, একদল মেয়ের অদম্য সাহস, আর একটা খেলার নতুন অধ্যায়? বাহরাইনের ঈসা স্পোর্টস সিটিতে যখন আমাদের অনূর্ধ্ব-১৮ বালিকা কাবাডি দল শ্রীলঙ্কাকে ৪৭-৪০ পয়েন্টে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জিতল, তখন পুরো বাংলাদেশ বুঝতে পারলো—আমরা পারি। এই প্রথমবার যুব এশিয়ান গেমস কাবাডি বাংলাদেশ এর জন্য পদক এনে দিল।

আমি যখন প্রথম খবরটা শুনি, মনে মনে ভাবলাম—এটা তো শুধু একটা ব্রোঞ্জ পদক নয়, এটা আসলে আমাদের জাতীয় খেলার নতুন জীবন। চলুন, আজ আমরা এই বিজয়ের পুরো গল্পটা জানি।

বাহরাইনে বাংলাদেশের সোনালি মুহূর্ত

তৃতীয় এশিয়ান যুব গেমস ২০২৫ বাহরাইনের মানামা আর রিফফায় চলছে ২২ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। এই বহু-ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এশিয়া জুড়ে যুব ক্রীড়াবিদরা অংশ নিচ্ছেন। কাবাডির ইভেন্ট শুরু হয়েছিল ১৯ অক্টোবর, আর ২০ অক্টোবর আমাদের মেয়েরা ইতিহাস তৈরি করে ফেললো।

বাংলাদেশ নারী কাবাডি দল যখন কোর্টে নামলো, তখন তাদের সামনে ছিল শ্রীলঙ্কা—একটা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। কিন্তু জানেন তো, চাপের মধ্যেই আসল হীরার দেখা মেলে। পুরো ম্যাচ জুড়ে আমাদের মেয়েরা এমন দক্ষতা আর কৌশল দেখালো যে শেষে ৪৭-৪০ পয়েন্টে জিতে গেল।

এর আগে ২০০৯ সালে সিঙ্গাপুরে, আর ২০১৩ সালে চীনের নানজিংয়ে বাংলাদেশ যুব এশিয়ান গেমসে অংশ নিয়েও পদকশূন্য ফিরেছিল। এবার প্রথমবার—বাংলাদেশ যুব এশিয়ান গেমসে ইতিহাস লেখা হলো।

গ্রুপ পর্ব থেকে পদক জয়

চলুন সৎ থাকি—শুরুটা একদম মসৃণ ছিল না। গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশ নারী কাবাডি দল যখন ভারত, ইরান, থাইল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হলো, তখন কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

প্রথম ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে ১৮-৪৬ তে হেরে গেল আমাদের দল। তারপর ইরান আর থাইল্যান্ডের কাছেও পরাজয়। কিন্তু আপনি জানেন, সত্যিকারের চ্যাম্পিয়নরা কখনো হাল ছাড়ে না।

মোট পাঁচটি দল নারী কাবাডিতে অংশ নিয়েছিল:

  • ভারত
  • ইরান
  • বাংলাদেশ
  • শ্রীলঙ্কা
  • থাইল্যান্ড

পুরুষ বিভাগে সাতটি দল ছিল—বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা আর বাহরাইন।

কাবাডি: আমাদের জাতীয় খেলার ঐতিহ্য

এখানে একটা মজার বিষয় আছে। জাতীয় খেলা কাবাডি বাংলাদেশ এর অফিশিয়াল খেলা হলেও, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা সবসময় চোখে পড়ার মতো সাফল্য পাইনি। ১৯৭২ সালে হাডুডু খেলাকে “কাবাডি” নামে জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ অ্যামেচার কাবাডি ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়, আর ১৯৭৮ সালে এশীয় অপেশাদার কাবাডি ফেডারেশনে যোগ দিয়েছিলাম আমরা।

কিন্তু সত্যি কথা বলতে, গ্রামবাংলায় যে কাবাডি (বা হাডুডু) খেলা এক সময় এত জনপ্রিয় ছিল, সেটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছিল। আর এখন? এই পদক হয়তো সেই হারিয়ে যাওয়া আগ্রহকে ফিরিয়ে আনবে।

বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের ভূমিকা

বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন দেশের কাবাডির সর্বোচ্চ জাতীয় সংস্থা। সাধারণ সম্পাদক এস এম নেওয়াজ সোহাগের নেতৃত্বে এই ফেডারেশন আমাদের তরুণ খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতি আর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সব ব্যবস্থা করেছে।

এবারের বাহরাইন এশিয়ান যুব গেমস এ মোট ২৮ জন কাবাডি খেলোয়াড় (পুরুষ আর নারী মিলে) অংশ নিয়েছেন। অফিসিয়াল মিলিয়ে পুরো দলে ৩৩ জন সদস্য ছিল। এই যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি, এটা ছাড়া এই সাফল্য সম্ভব ছিল না।

ম্যাচ হাইলাইটস

২০ অক্টোবর ঈসা স্পোর্টস সিটি বাহরাইন এ যখন বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কা ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচ শুরু হলো, তখন টেনশনের মাত্রা ছিল আকাশছোঁয়া। আমাদের বাংলাদেশ কাবাডি দলের খেলোয়াড় রা জানতো—এটা শুধু একটা ম্যাচ নয়, এটা একটা মাইলস্টোন।

ম্যাচের মূল পয়েন্টস:

দল স্কোর ফলাফল
বাংলাদেশ ৪৭ বিজয়ী (ব্রোঞ্জ পদক)
শ্রীলঙ্কা ৪০ পরাজিত

প্রথম হাফে বাংলাদেশ দুর্দান্ত রেইড আর ডিফেন্স দেখিয়ে এগিয়ে যায়। শ্রীলঙ্কা চাপ দিলেও আমাদের মেয়েরা সামলে নিতে পেরেছিল। দ্বিতীয় হাফেও এই গতি ধরে রাখতে পেরে শেষমেশ সাত পয়েন্টের ব্যবধানে জিতে যায় বাংলাদেশ।

যুব এশিয়ান গেমস

যুব এশিয়ান গেমস (Asian Youth Games বা AYG) হলো একটা বহু-ক্রীড়া ইভেন্ট যেখানে ১৪-১৮ বছরের এশিয়ান ক্রীড়াবিদরা অংশ নেয়। এশিয়া অলিম্পিক কাউন্সিল প্রতি চার বছর পর পর এই গেমস আয়োজন করে।

২০২৫ সালের এই তৃতীয় আসরে বাহরাইন হোস্ট করছে। এর আগে:

  • প্রথম আসর: সিঙ্গাপুর (২০০৯)
  • দ্বিতীয় আসর: নানজিং, চীন (২০১৩)

এখানে শুধু কাবাডি নয়, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল সহ আরও অনেক খেলা হচ্ছে।

কাবাডি খেলার নিয়ম

আপনি হয়তো ভাবছেন, “কাবাডি আসলে কী?” চলুন দ্রুত জেনে নিই। কাবাডি খেলার নিয়ম ও কৌশল বেশ সিম্পল কিন্তু রোমাঞ্চকর।

মূল নিয়ম:

  • দুটো দল, প্রতিটিতে সাতজন করে খেলোয়াড়
  • এক দল রেইড করে (আক্রমণ), অন্য দল ডিফেন্ড করে
  • রেইডার “কাবাডি কাবাডি” বলতে বলতে প্রতিপক্ষের কোর্টে ঢুকে কাউকে টাচ করে আবার নিজের কোর্টে ফিরতে হয়
  • ডিফেন্ডাররা রেইডারকে ধরার চেষ্টা করে
  • প্রতিটি সফল রেইড বা ডিফেন্সে পয়েন্ট পাওয়া যায়

শুনতে সহজ মনে হলেও এখানে ফিটনেস, স্ট্র্যাটেজি, টিমওয়ার্ক সব লাগে। আর আমাদের মেয়েরা এই সবকিছুতেই দুর্দান্ত ছিল।

এই পদক কী পরিবর্তন আনবে?

এই বাংলাদেশ ব্রোঞ্জ পদক কাবাডি জয়ের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। কেন? চলুন দেখি:

তাৎক্ষণিক প্রভাব:

  • তরুণদের মধ্যে কাবাডির প্রতি আগ্রহ বাড়বে
  • সরকারি পর্যায়ে আরও বরাদ্দ আসতে পারে
  • মিডিয়া কভারেজ বাড়বে

দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা:

  • ভবিষ্যতে আরও বড় প্রতিযোগিতায় ভালো করার রাস্তা তৈরি হলো
  • কাবাডি বিশ্বকাপ বাংলাদেশ ২০২৫ বা এশিয়ান গেমসে আমরা এখন আত্মবিশ্বাসের সাথে নামতে পারবো
  • গ্রামাঞ্চলে কাবাডির জনপ্রিয়তা ফিরে আসবে

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এই পদক শুধু একটা ধাতব বস্তু নয়—এটা একটা স্টেটমেন্ট। এটা বলছে যে হাডুডু বা কাবাডি ঐতিহ্যবাহী খেলা হিসেবে আমাদের যে ঐতিহ্য, সেটা আন্তর্জাতিক মঞ্চেও প্রমাণ করতে পারি আমরা।

পদক তালিকায় বাংলাদেশ

যদিও এশিয়ান যুব গেমস পদক তালিকা ২০২৫ এ আমাদের অবস্থান নিচের দিকে থাকবে (একটা ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে), কিন্তু মনে রাখতে হবে—এটাই আমাদের প্রথম পদক। ভারত, চীন, জাপানের মতো দেশগুলো বছরের পর বছর ধরে যুব স্পোর্টসে বিনিয়োগ করছে। আমরা এখন শুরু করলাম মাত্র।

কাবাডিতে ফাইনাল র‍্যাংকিং:

  1. স্বর্ণ: (প্রকাশিত হয়নি এখনও)
  2. রৌপ্য: (প্রকাশিত হয়নি এখনও)
  3. ব্রোঞ্জ: বাংলাদেশ
  4. ফোর্থ: শ্রীলঙ্কা

আমাদের যোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা

বাংলাদেশ পুরুষ কাবাডি দল যুব এশিয়ান এও দুর্দান্ত লড়াই করেছে, যদিও পদক জিততে পারেনি। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টাও সমান স্বীকৃতির দাবিদার। ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য শুধু পদকে মাপা যায় না—প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা আর লড়াই করার মানসিকতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

আর বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন কাবাডি বিভাগ যারা এই পুরো প্রস্তুতি সামলেছেন, তাদের অবদান অসামান্য। কোচিং স্টাফ, ম্যানেজমেন্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট—সবাই এই সাফল্যের অংশীদার।

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে

এখন প্রশ্ন হলো—এরপর কী? বাংলাদেশ ক্রীড়াঙ্গনে কাবাডির অবদান আরও বাড়ানোর জন্য কী করা উচিত?

আমার কিছু সাজেশন:

  • প্রশিক্ষণ সুবিধা বাড়ানো: গ্রাম পর্যায়ে কাবাডি একাডেমি খোলা
  • নিয়মিত প্রতিযোগিতা: জাতীয় পর্যায়ে আরও টুর্নামেন্ট আয়োজন
  • স্পন্সরশিপ: কর্পোরেট হাউসগুলোকে কাবাডিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করা
  • মিডিয়া কভারেজ: টিভি চ্যানেলগুলোতে কাবাডি ম্যাচ সম্প্রচার
  • স্কুল লেভেল: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাবাডিকে বাধ্যতামূলক খেলা করা

আপনি কি জানেন, ভারতে প্রো কাবাডি লিগের কারণে কাবাডি কতটা জনপ্রিয় হয়েছে? আমরাও চাইলে এরকম কিছু করতে পারি। কল্পনা করুন, ঢাকার স্টেডিয়ামে হাজারো দর্শক কাবাডি ম্যাচ দেখছে—কী দারুণ হবে না?

FAQs

১. যুব এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে বাংলাদেশ কোন পদক জিতেছে?

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ নারী কাবাডি দল ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে, যা বাংলাদেশের জন্য যুব এশিয়ান গেমসের ইতিহাসে প্রথম পদক। এটা সত্যিই একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত।

২. যুব এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ কাবাডিতে কাকে হারিয়ে পদক জিতেছে?

বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা কাবাডি ম্যাচে বাংলাদেশ ৪৭-৪০ পয়েন্টে জিতে ব্রোঞ্জ পদক নিশ্চিত করে। ম্যাচটি ২০ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে বাহরাইনের ঈসা স্পোর্টস সিটিতে খেলা হয়।

৩. যুব এশিয়ান গেমস ২০২৫ কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছে?

তৃতীয় এশিয়ান যুব গেমস ২০২৫ বাহরাইনের মানামা ও রিফফায় ২২ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মানামা বাহরাইন যুব এশিয়ান গেমস এর কাবাডি ইভেন্ট ১৯-২৩ অক্টোবর পর্যন্ত হয়েছে।

৪. কাবাডি কি বাংলাদেশের জাতীয় খেলা?

হ্যাঁ, কাবাডি (আগে হাডুডু নামে পরিচিত) বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয় খেলার মর্যাদা দেওয়া হয়।

৫. এর আগে যুব এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের পদক প্রাপ্তির রেকর্ড কী ছিল?

যুব এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এর ইতিহাসে এর আগে কখনো পদক জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০৯ (সিঙ্গাপুর) আর ২০১৩ (নানজিং) এর দুই আসরেই পদকশূন্য ছিল।

৬. যুব এশিয়ান গেমসে কাবাডিতে কতটি দল অংশ নিয়েছে?

নারী কাবাডিতে পাঁচটি দল অংশ নিয়েছে—বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, শ্রীলঙ্কা এবং থাইল্যান্ড। পুরুষ বিভাগে সাতটি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে।

উপসংহার

তো বন্ধুরা, এটাই যুব এশিয়ান গেমস প্রথম পদক জয়ের গল্প। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখনও মনে হচ্ছে—এটা একটা স্বপ্নের মতো। কিন্তু না, এটা বাস্তব। আমাদের মেয়েরা প্রমাণ করেছে যে সঠিক প্রস্তুতি, কঠোর পরিশ্রম আর দৃঢ় মানসিকতা থাকলে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়।

এশিয়ান গেমস কাবাডি বাংলাদেশের সাফল্য এর এটা শুধু শুরু। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই মোমেন্টামকে ধরে রাখা। আপনারা যারা পড়ছেন, আপনাদের প্রতি আমার অনুরোধ—কাবাডি খেলা দেখুন, সাপোর্ট করুন, আর সম্ভব হলে খেলুনও।

আমাদের জাতীয় খেলাকে আবার তার গৌরবময় অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে সবার সহযোগিতা দরকার। এই ব্রোঞ্জ পদক একদিন সোনায় রূপান্তরিত হবে—এটাই আমার বিশ্বাস।

আপনার কি মনে হয়? এই পদক বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে কী পরিবর্তন আনবে? কমেন্ট সেকশনে আপনার মতামত জানান। আর হ্যাঁ, এই লেখা যদি ভালো লাগে, তাহলে শেয়ার করে আরও মানুষকে জানতে সাহায্য করুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top