সামাজিক সংগঠনের নীতিমালা

আপনি এবং আপনার বন্ধুরা মিলে সমাজের জন্য ভালো কিছু করতে চান। হয়তো আপনারা একটি লাইব্রেরি গড়তে চান, শীতার্তদের সাহায্য করতে চান, বা এলাকার পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে চান। ভাবনাটা অসাধারণ! কিন্তু যেকোনো বড় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে একটি মজবুত কাঠামোর প্রয়োজন হয়। সামাজিক সংগঠনের ক্ষেত্রে সেই কাঠামো হলো এর নীতিমালা বা গঠনতন্ত্র

অনেকেই দারুণ সব পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেন, কিন্তু কিছুদিন পর নিজেদের মধ্যেই ভুল বোঝাবুঝি, দায়িত্ব নিয়ে টানাটানি বা আর্থিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়েন। এর মূল কারণ কী জানেন? একটি সুস্পষ্ট নীতিমালার অভাব।

ভাবছেন, এত কঠিন কঠিন শব্দ—গঠনতন্ত্র, নীতিমালা—এসব তৈরি করা নিশ্চয়ই খুব ঝামেলার? একদমই না! আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এই আর্টিকেলটি পড়ার পর আপনার কাছে পুরো বিষয়টি পানির মতো সহজ মনে হবে। চলুন, আজ আমরা ধাপে ধাপে জেনে নিই কীভাবে একটি সামাজিক সংগঠনের জন্য আদর্শ নীতিমালা তৈরি করতে হয়।

 

কেন একটি নীতিমালা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

 

একটা গাড়ি যেমন ড্রাইভারের নির্দেশনায় চলে, তেমনি একটি সংগঠন তার নীতিমালা মেনে চলে। এই নীতিমালা হলো আপনার সংগঠনের সংবিধান। কেন এটি এতটা জরুরি?

  • পরিষ্কার দিকনির্দেশনা: সংগঠনের লক্ষ্য কী, কারা সদস্য হতে পারবে, কার কী দায়িত্ব—এই সবকিছু নীতিমালায় স্পষ্টভাবে লেখা থাকে। ফলে সবাই নিজের ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায়।
  • দ্বন্দ্ব এড়ানো যায়: ভবিষ্যতে সদস্যদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে, নীতিমালার সাহায্যেই তার সমাধান করা যায়। এটি একটি নিরপেক্ষ রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।
  • আইনি স্বীকৃতি: আপনি যদি আপনার সংগঠনকে সরকারিভাবে নিবন্ধন (Registration) করতে চান, তাহলে একটি পূর্ণাঙ্গ গঠনতন্ত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এটি ছাড়া আপনার সংগঠন আইনি বৈধতা পাবে না।
  • বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে: যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আপনার সংগঠনে অনুদান দিতে চাইবে, তারা প্রথমেই আপনার নীতিমালা দেখতে চাইবে। একটি গোছানো নীতিমালা আপনার সংগঠনের স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব ফুটিয়ে তোলে।

 

সামাজিক সংগঠনের নীতিমালার প্রধান অংশগুলো কী কী?

 

একটি আদর্শ নীতিমালায় কয়েকটি অপরিহার্য অংশ থাকে। নিচে আমরা একটি তালিকা আকারে সেগুলো আলোচনা করছি। আপনি আপনার সংগঠনের প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো সাজিয়ে নিতে পারেন।

 

১. সংগঠনের নাম ও ঠিকানা

 

এটি আপনার পরিচয়ের প্রথম ধাপ।

  • নাম: একটি সুন্দর, অর্থবহ এবং সহজ নাম নির্বাচন করুন যা আপনার সংগঠনের উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে।
  • ঠিকানা: সংগঠনের অস্থায়ী ও স্থায়ী কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করুন।

 

২. সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

 

আপনি কেন এই সংগঠন তৈরি করছেন? এর মূল উদ্দেশ্য কী? এই অংশে সেই বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে লিখুন। যেমন:

  • দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষ উপকরণ দিয়ে সাহায্য করা।
  • এলাকায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আয়োজন করা।
  • রক্তদান কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য সচেতনতা ক্যাম্পেইন করা।
  • সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণদের একত্রিত করা।

টিপস: উদ্দেশ্যগুলো নম্বর দিয়ে পয়েন্ট আকারে লিখুন। এতে পড়তে সুবিধা হয়।

 

৩. সদস্যপদ

 

সংগঠনে কারা যোগ দিতে পারবেন এবং কীভাবে, সেই নিয়মগুলো এখানে থাকবে।

  • সদস্য হওয়ার যোগ্যতা: সদস্য হতে কী কী যোগ্যতা লাগবে (যেমন: বয়স, পেশা, নির্দিষ্ট এলাকার বাসিন্দা)?
  • সদস্যদের প্রকারভেদ: সাধারণত সংগঠনে সাধারণ সদস্য, আজীবন সদস্য, বা সম্মানিত সদস্য—এরকম কয়েকটি ভাগ থাকে।
  • সদস্যপদ বাতিল: কোন কোন কারণে একজন সদস্যের পদ বাতিল হতে পারে (যেমন: সংগঠনের নিয়ম ভঙ্গ করলে, পর পর কয়েকটি মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকলে)?

 

৪. কমিটি গঠন ও কার্যপরিধি

 

সংগঠন পরিচালনার জন্য একটি কমিটি অপরিহার্য। একটি সামাজিক সংগঠনের কমিটি গঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। কমিটিতে সাধারণত নিচের পদগুলো থাকে।

পদবি প্রধান দায়িত্ব
সভাপতি সভায় সভাপতিত্ব করা এবং সংগঠনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা।
সহ-সভাপতি সভাপতির অনুপস্থিতিতে তার দায়িত্ব পালন করা।
সাধারণ সম্পাদক সংগঠনের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা, মিটিং ডাকা, এবং সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা।
কোষাধ্যক্ষ সংগঠনের আর্থিক হিসাব-নিকাশ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা।
সাংগঠনিক সম্পাদক সংগঠনকে শক্তিশালী করা এবং নতুন সদস্য সংগ্রহে কাজ করা।
প্রচার সম্পাদক সংগঠনের কার্যক্রমগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে (সোশ্যাল মিডিয়া, প্রেস রিলিজ) প্রচার করা।
কার্যনির্বাহী সদস্য কমিটির অন্যান্য কাজে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করা।

মনে রাখবেন, আপনার সংগঠনের আকার ও প্রয়োজন অনুযায়ী পদের সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে।

 

৫. সামাজিক সংগঠনের মিটিং পরিচালনার নিয়ম

 

সংগঠনের কার্যক্রম সচল রাখতে নিয়মিত মিটিং প্রয়োজন। কিন্তু মিটিং কীভাবে পরিচালিত হবে?

  • সাধারণ সভা (AGM): বছরে অন্তত একবার বার্ষিক সাধারণ সভা করতে হবে, যেখানে বাৎসরিক রিপোর্ট ও আর্থিক হিসাব পেশ করা হয়।
  • কার্যনির্বাহী সভা: কমিটির সদস্যরা মাসে বা দুই মাসে একবার এই সভা করতে পারেন।
  • জরুরি সভা: বিশেষ প্রয়োজনে যেকোনো সময় জরুরি সভা ডাকা যেতে পারে।
  • কোরাম: একটি সভা বৈধ হওয়ার জন্য মোট সদস্যের কত অংশ উপস্থিত থাকতে হবে (সাধারণত এক-তৃতীয়াংশ), তা উল্লেখ করতে হবে।

 

৬. আর্থিক ব্যবস্থাপনা

 

যেকোনো অলাভজনক সংগঠনের নীতিমালা-তে আর্থিক স্বচ্ছতার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

  • তহবিল: সংগঠনের আয়ের উৎস কী হবে? (যেমন: সদস্য চাঁদা, অনুদান, ইত্যাদি)।
  • ব্যাংক অ্যাকাউন্ট: সংগঠনের নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে, যা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং কোষাধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হবে।
  • হিসাব নিরীক্ষা (Audit): প্রতি বছর একজন অডিটর দ্বারা সংগঠনের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা করাতে হবে।

 

৭. নীতিমালা সংশোধন ও বিলুপ্তি

 

  • সংশোধন: কীভাবে সংগঠনের নীতিমালা পরিবর্তন বা সংশোধন করা যাবে? সাধারণত, সাধারণ সভার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে এটি করা হয়।
  • বিলুপ্তি: যদি কোনো কারণে সংগঠন বিলুপ্ত করার প্রয়োজন হয়, সেই প্রক্রিয়া কী হবে এবং সংগঠনের সম্পদ কীভাবে বণ্টন করা হবে, তার নিয়মাবলী এখানে উল্লেখ করতে হবে।

 

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)

 

প্রশ্ন: একটি সামাজিক সংগঠনের গঠনতন্ত্র কেমন হওয়া উচিত?

উত্তর: একটি ভালো গঠনতন্ত্র সহজ ভাষায় লেখা উচিত। এতে সংগঠনের নাম, ঠিকানা, লক্ষ্য, সদস্যপদ, কমিটি, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং বিলুপ্তির নিয়মাবলী স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। এটি যেন সংগঠনের সকল সদস্য সহজেই বুঝতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

প্রশ্ন: সামাজিক সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি কী?

উত্তর: বাংলাদেশে সমাজসেবা অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর অথবা রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (RJSC) থেকে সামাজিক সংগঠনের নিবন্ধন করা যায়। এর জন্য নির্ধারিত ফর্মে আবেদন করতে হয় এবং তার সাথে সংগঠনের গঠনতন্ত্র, কার্যনির্বাহী কমিটির তালিকা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়।

প্রশ্ন: অলাভজনক সংগঠনের নীতিমালা কি আলাদা হয়?

উত্তর: মূলত, সামাজিক সংগঠনগুলো অলাভজনকই হয়ে থাকে। তাই এদের নীতিমালা প্রায় একই রকম। মূল ফোকাস থাকে সামাজিক কল্যাণ ও স্বচ্ছতার ওপর। তবে কিছু ক্ষেত্রে (যেমন: ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশন) নীতিমালায় আইনি বাধ্যবাধকতা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।

 

উপসংহার

 

একটি নীতিমালা বা গঠনতন্ত্র তৈরি করাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এটি আসলে আপনার স্বপ্নের একটি লিখিত রূপ, যা আপনার সংগঠনকে দীর্ঘস্থায়ী ও সফল করতে সাহায্য করবে। এটি আপনার সংগঠনকে পেশাদারিত্ব দেবে এবং সদস্যদের মধ্যে আস্থা তৈরি করবে।

তাহলে আর দেরি কেন? আজই আপনার দলের সদস্যদের নিয়ে বসুন এবং এই গাইডলাইন অনুসরণ করে নিজেদের সংগঠনের জন্য একটি সুন্দর নীতিমালা তৈরি করে ফেলুন। মনে রাখবেন, একটি ভালো শুরু মানেই অর্ধেক কাজ হয়ে যাওয়া!

আপনারা কোন ধরনের সামাজিক কাজ করতে আগ্রহী? কমেন্ট বক্সে আমাদের জানাতে পারেন!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top