২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলে গণতান্ত্রিক ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার সংস্কারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই ঐকমত্যের ফলস্বরূপ ১৬ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রকাশিত হয়েছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক যাত্রার একটি বিস্তারিত পথরেখা তুলে ধরে।
পটভূমি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এবং পাকিস্তানের স্বৈরশাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব-বাংলার জনগণের দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, দীর্ঘ ৫৩ বছরে তা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন (বাকশাল) এবং পরবর্তীতে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার ব্যাহত হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, দুর্নীতি এবং প্রহসনমূলক নির্বাচন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেয়। এই পটভূমিতে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র-কাঠামো সংস্কারের এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে।
সংস্কার কমিশন ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন:
গণঅভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রথমে পাঁচটি এবং পরে সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ মোট ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এই কমিশনগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে। এই সুপারিশগুলোর ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সহ-সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে নিবিড় আলোচনার মাধ্যমে সনদটি প্রণয়ন করে।
সনদের মূল প্রস্তাবনা ও ঐকমত্যের বিষয়সমূহ:
জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো হয়েছে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিচে তুলে ধরা হলো:
- সংবিধান সংশোধন সাপেক্ষে সংস্কার:
- ভাষা ও নাগরিকত্ব: প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা এবং অন্যান্য মাতৃভাষাকে প্রচলিত ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। বাংলাদেশের নাগরিকগণ ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবেন।
- সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি: সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদের নিম্নকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হবে। তবে প্রস্তাবনাসহ কিছু সুনির্দিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে।
- জরুরি অবস্থা ঘোষণা: ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য মন্ত্রিসভার অনুমোদন এবং বিরোধীদলীয় উপনেতার উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। জরুরি অবস্থাকালীন জীবনের অধিকার এবং বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না।
- রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি: ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ মূলনীতি অংশে উল্লেখ থাকবে। বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি-গোষ্ঠী, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
- রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী: রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষের সদস্যদের গোপন ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং তার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী পদে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন এবং একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না।
- তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা: সংসদ নির্বাচনের জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হবে, যার বিস্তারিত গঠন প্রক্রিয়া সনদে বর্ণিত হয়েছে।
- আইনসভা:
- দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা: বাংলাদেশে একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা (নিম্নকক্ষ-জাতীয় সংসদ এবং উচ্চকক্ষ-সিনেট) থাকবে।
- নারী প্রতিনিধিত্ব: জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করা হবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধারণ নির্বাচনে ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ৫ শতাংশ বর্ধিত হারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন অব্যাহত রাখতে হবে।
- ডেপুটি স্পিকার ও স্থায়ী কমিটির সভাপতি: আইনসভার উভয় কক্ষে একজন করে ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। সরকারি হিসাব কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে বিরোধীদলীয় সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন।
- দলের বিরুদ্ধে ভোটদান: সংসদ সদস্যরা কেবল অর্থবিল এবং আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতি অনুগত থাকবেন; অন্য যেকোনো বিষয়ে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন।
- আন্তর্জাতিক চুক্তি: জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন আন্তর্জাতিক চুক্তি আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হবে।
- নির্বাচন ব্যবস্থা:
- সীমানা পুনঃনির্ধারণ: প্রতি জনশুমারি বা অনধিক ১০ বছর পর পর সংসদীয় নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি অস্থায়ী বিশেষায়িত কমিটি গঠিত হবে।
- বিচার বিভাগ:
- প্রধান বিচারপতি নিয়োগ: রাষ্ট্রপতি আপীল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন এবং জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগদান করা হবে (তবে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান থাকলে নয়)।
- বিচারক নিয়োগ কমিশন: সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (JAC) গঠন করা হবে।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিকেন্দ্রীকরণ: বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হবে এবং সুপ্রীম কোর্টের প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা হবে।
- বিচারকদের আচরণবিধি ও সম্পত্তি বিবরণী: সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল কর্তৃক বিচারকদের জন্য পালনীয় আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রকাশ করা হবে। প্রতি ৩ বছর পর পর বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির বিবরণ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে।
- সুপ্রীম কোর্ট সচিবালয় ও ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস: বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে কার্যকরভাবে পৃথকীকরণের লক্ষ্যে সুপ্রীম কোর্টের নিজস্ব সচিবালয় থাকবে এবং একটি স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠনের জন্য আইন প্রণয়ন করা হবে।
- জনপ্রশাসন:
- তথ্য অধিকার আইন ও অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট: তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ সংশোধন করা হবে এবং অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ পর্যালোচনা করে সংশোধন করা হবে।
- গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির তদন্ত: জুলাই অভ্যুত্থানকালে গণহত্যা ও নিপীড়নের সাথে জড়িত এবং ভোট জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের চিহ্নিতকরণের জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠিত হবে।
- সরকারি কর্ম কমিশন ও নিরীক্ষা বিভাগ: জনবল নিয়োগের জন্য তিনটি সরকারি কর্ম কমিশন গঠন করা হবে এবং নিরীক্ষা বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিরীক্ষা আইন প্রণয়ন করা হবে।
- নতুন প্রশাসনিক বিভাগ: কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুইটি নতুন প্রশাসনিক বিভাগ গঠিত হবে।
- দুর্নীতি দমন কমিশন:
- সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর ও নিয়োগ: দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হবে এবং ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’র মাধ্যমে এর চেয়ারম্যান ও কমিশনারগণ নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
- বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দানের চর্চা বন্ধ: বৈধ উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দানের যেকোনো রাষ্ট্রীয় চর্চা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ করতে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা হবে।
- স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও অর্থ পাচার রোধ: রাষ্ট্রীয় ও আইনি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন ও প্রতিরোধ সংক্রান্ত আইন এবং দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধে সুবিধাভোগী মালিকানা সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হবে।
- নির্বাচনি অর্থায়নে স্বচ্ছতা: রাজনৈতিক দলসমূহ ও নির্বাচনের প্রার্থীগণ অর্থায়ন এবং আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করবে।
- বেসরকারি খাতের দুর্নীতি: বেসরকারি খাতের দুর্নীতিকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
- দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র ও অটোমেশন: একটি দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হবে এবং পরিষেবা খাতের কার্যক্রম ও তথ্য অটোমেশন করা হবে।
বাস্তবায়নের অঙ্গীকার:
সনদে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছে। তারা ঘোষণা করেছে যে, এই সনদ জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি এবং এটিকে পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে। সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে না এবং এর বাস্তবায়নে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে। গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপসংহার:
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক, সুশাসনভিত্তিক এবং জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এটি কেবল একটি সংস্কার দলিল নয়, বরং জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা ও ত্যাগের ফলস্বরূপ অর্জিত একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সমঝোতা। এই সনদের সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।