স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নীতিমালা: যা জানা জরুরি প্রতিটি সামাজিক কর্মীর
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আসলে কীভাবে চলে? কেন কিছু সংগঠন সফল হয় আর কিছু মাঝপথেই থেমে যায়? আমি যখন প্রথম একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যোগ দিয়েছিলাম, তখন মনে হয়েছিল সব কিছু খুব সহজ। কিন্তু না, বন্ধু! একটা সংগঠন সুচারুভাবে চালাতে হলে আপনার দরকার পরিষ্কার নীতিমালা এবং গঠনতন্ত্র।
আজকে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নীতিমালা নিয়ে সব কিছু যা আপনার জানা দরকার, চাই আপনি একজন নতুন স্বেচ্ছাসেবক হন কিংবা একটা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আসলে কী?
চলুন শুরু করা যাক একদম বেসিক থেকে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হলো এমন একটা প্রতিষ্ঠান যেখানে মানুষ নিঃস্বার্থভাবে, বিনা পারিশ্রমিকে সমাজের কল্যাণে কাজ করে। মনে করুন, আপনার এলাকায় একটা শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম চালাচ্ছেন, কিংবা দরিদ্র মানুষদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন এগুলো সবই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজের আওতায় পড়ে।
এসব সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য থাকে সমাজের উন্নয়ন, দরিদ্র বিমোচন, শিক্ষা প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ। টাকার জন্য নয়, মানুষের কল্যাণের জন্যই এই সংগঠনগুলো কাজ করে।
বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিবন্ধন
এখন আসি আসল কথায়। আপনি যদি একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন খুলতে চান, তাহলে আপনাকে নিবন্ধন করাতে হবে। বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ অনুযায়ী সমাজসেবা অধিদপ্তরে নিবন্ধন করতে হয়।
নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
নিবন্ধন প্রক্রিয়াটা একটু জটিল মনে হতে পারে, কিন্তু ভাঙলে দেখবেন খুব একটা কঠিন না:
- প্রথমে আপনার সংগঠনের নামের ছাড়পত্র নিতে হবে
- একটা পরিষ্কার গঠনতন্ত্র তৈরি করতে হবে
- সদস্যদের তালিকা এবং পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে
- সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিবরণ লিখতে হবে
- আবেদন ফরম পূরণ করে নির্ধারিত ফি দিয়ে জমা দিতে হবে
সমাজসেবা অধিদপ্তরে সংগঠন নিবন্ধন প্রক্রিয়া
আমার এক বন্ধু গত বছর একটা সংগঠন নিবন্ধন করেছিল। সে বলছিল, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো আপনার কাগজপত্র সব ঠিকঠাক রাখা। একবার আপনি আবেদন জমা দিলে, অফিস থেকে যাচাই-বাছাই করে দেখবে। যদি সব কিছু ঠিক থাকে, তাহলে কয়েক মাসের মধ্যেই আপনার নিবন্ধন সনদ পেয়ে যাবেন।
গঠনতন্ত্র
গঠনতন্ত্র হলো আপনার সংগঠনের বাইবেল। এখানে লেখা থাকবে আপনার সংগঠন কীভাবে চলবে, কে কী করবে, কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সব কিছু।
গঠনতন্ত্রে যা থাকা আবশ্যক
একটা ভালো গঠনতন্ত্রে এই বিষয়গুলো অবশ্যই থাকতে হবে:
সংগঠনের পরিচয়: নাম, ঠিকানা, এবং যোগাযোগের তথ্য। এটা শুনতে সহজ মনে হলেও, আপনার সংগঠনের পরিচয় পরিষ্কারভাবে লেখা থাকা খুব জরুরি।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য: আপনি কী করতে চাইছেন? শিক্ষা? স্বাস্থ্য? পরিবেশ? স্পষ্টভাবে লিখুন। মনে রাখবেন, অস্পষ্ট উদ্দেশ্য মানে অস্পষ্ট দিকনির্দেশনা।
সদস্যপদ নিয়মাবলী: কারা সদস্য হতে পারবে, কীভাবে হবে, সদস্যদের অধিকার এবং দায়িত্ব কী সব কিছু লিখে রাখুন।
সাংগঠনিক কাঠামো: কার্যকরী পরিষদ, সাধারণ পরিষদ, উপদেষ্টা পরিষদ কে কী করবে সেটা নির্ধারণ করুন।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা: টাকা কীভাবে আসবে, কীভাবে খরচ হবে, কীভাবে হিসাব রাখা হবে এসব নিয়ম লিখুন। আর্থিক স্বচ্ছতা একটা সংগঠনের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ।
সভা আহবান পদ্ধতি: কখন সভা হবে, কীভাবে ডাকা হবে, কতজন সদস্য থাকলে সভা বৈধ হবে।
নির্বাচন পদ্ধতি: কীভাবে নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে, কত বছর মেয়াদ হবে।
বিলুপ্তির শর্ত: যদি কখনো সংগঠন বন্ধ করতে হয়, তাহলে সম্পত্তি কোথায় যাবে।
সংগঠন পরিচালনার তিন স্তম্ভ
একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে সাধারণত তিনটা প্রধান পরিষদ থাকে। চলুন দেখি এদের ভূমিকা কী।
কার্যকরী পরিষদ
কার্যকরী পরিষদ হলো সংগঠনের ড্রাইভিং ফোর্স। এখানে থাকেন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ এবং অন্যান্য পদাধিকারীরা। এরাই সংগঠনের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনা করেন, বড় সিদ্ধান্ত নেন এবং সংগঠনের দিকনির্দেশনা ঠিক করেন।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, একটা শক্তিশালী কার্যকরী পরিষদ মানেই একটা সফল সংগঠন। এদের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে, দায়িত্ববোধ থাকতে হবে।
সাধারণ পরিষদ
সাধারণ পরিষদ হলো সব সাধারণ সদস্যদের নিয়ে গঠিত। এরা কার্যকরী পরিষদ নির্বাচন করে, বড় সিদ্ধান্তে ভোট দেয় এবং সংগঠনের কর্মকাণ্ড তদারকি করে। মনে করতে পারেন এটা একটা গণতান্ত্রিক সংগঠনের পার্লামেন্টের মতো।
উপদেষ্টা পরিষদ
উপদেষ্টা পরিষদে থাকেন অভিজ্ঞ, জ্ঞানী মানুষেরা যারা সংগঠনকে পরামর্শ দেন। এরা সরাসরি পরিচালনায় জড়িত নন, কিন্তু তাদের দিকনির্দেশনা অমূল্য।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মূল নীতিমালা
এবার আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মূল নীতিমালা। এগুলো হলো সেই আদর্শ যা একটা সংগঠনকে টিকিয়ে রাখে।
১. একতা
একতা ছাড়া কোনো সংগঠন চলতে পারে না। সবাই যদি আলাদা দিকে টানে, তাহলে সংগঠন ভেঙে পড়বে। “একতায় শক্তি” এই কথাটা শুধু একটা প্রবাদ না, এটা বাস্তব সত্য।
২. সততা
আমি বহুবার দেখেছি, অসততার কারণে কত প্রতিশ্রুতিশীল সংগঠন ধ্বংস হয়ে গেছে। সততা শুধু টাকার ক্ষেত্রে না, কথায়, কাজে, সিদ্ধান্তে সব জায়গায় দরকার।
৩. স্বেচ্ছাকৃত মিলন
কাউকে জোর করে সদস্য বানানো যায় না। মানুষ নিজের ইচ্ছায়, নিজের বিশ্বাস থেকে যোগ দেবে। তাহলেই তারা আন্তরিকভাবে কাজ করবে।
৪. সহযোগিতা
প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা। একজন আরেকজনকে সাহায্য করবে। একজনের দুর্বলতা আরেকজনের শক্তি দিয়ে পূরণ হবে।
৫. গণতন্ত্র
সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সবার মতামত শুনতে হবে। একজন বা কয়েকজনের একচ্ছত্র আধিপত্য চলবে না। ভোটে সিদ্ধান্ত হবে।
৬. সমঝোতা
মতভেদ হবেই। কিন্তু সেটা নিয়ে ঝগড়া না করে, সমঝোতায় আসতে হবে। মনে রাখবেন, লক্ষ্য একই সমাজসেবা।
৭. সবাই সমান
ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, পুরুষ-নারী সবাই সমান। কারো সাথে বৈষম্য করা যাবে না।
৮.মূল উদ্দেশ্য
মনে রাখতে হবে, আমরা এখানে সেবা করতে এসেছি। ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, সমাজের কল্যাণের জন্য।
৯. কাছাকাছি থাকা
সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হতে হবে। শুধু কাজের সম্পর্ক না, মানবিক সম্পর্ক তৈরি হোক।
১০. সম-ভোটাধিকার
সভাপতি হোক বা সাধারণ সদস্য সবার ভোটের মূল্য সমান। এটাই গণতন্ত্র।
১১. নিরপেক্ষতা
রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা অন্য কোনো পক্ষপাত থাকবে না। সংগঠন হবে সবার জন্য উন্মুক্ত।
কারা সদস্য হতে পারবেন?
সদস্য হওয়ার জন্য কোনো জটিল যোগ্যতা লাগে না। যদি আপনি:
- সংগঠনের উদ্দেশ্য এবং নীতিমালায় বিশ্বাস করেন
- ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী হন
- সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হন
- গঠনতন্ত্র মেনে চলতে সম্মত হন
তাহলে আপনি সদস্য হতে পারবেন।
স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্ব এবং অধিকার
দায়িত্ব:
- সংগঠনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিবেদিতভাবে কাজ করা
- গঠনতন্ত্র মেনে চলা
- সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করা
- সংগঠনের সুনাম রক্ষা করা
অধিকার:
- সংগঠন পরিচালনায় মতামত দেওয়ার অধিকার
- নির্বাচনে ভোট দেওয়ার এবং প্রার্থী হওয়ার অধিকার
- তথ্য জানার অধিকার
- অভিযোগ করার অধিকার
আর্থিক ব্যবস্থাপনা
টাকা-পয়সার হিসাব নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমি দেখেছি, আর্থিক অনিয়মের কারণে কত ভালো সংগঠন মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে।
আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া
- সব আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ রাখুন
- প্রতিটি লেনদেনের রসিদ সংরক্ষণ করুন
- বার্ষিক অডিট করান
- নিয়মিত সদস্যদের সামনে আর্থিক প্রতিবেদন পেশ করুন
- বড় খরচের সিদ্ধান্ত কার্যকরী পরিষদে নিন
অডিট ব্যবস্থা
বছরে অন্তত একবার একজন স্বাধীন অডিটর দিয়ে হিসাব যাচাই করান। এটা খরচের মনে হতে পারে, কিন্তু এটা আপনার সংগঠনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াবে।
সমস্যা সমাধানের পথ
কোনো সংগঠনই ঝগড়া-বিবাদ থেকে মুক্ত না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে আপনি সেটা সমাধান করছেন।
সমঝোতা কমিটি গঠন
যখন দুই সদস্যের বা দুই দলের মধ্যে মতবিরোধ হবে, তখন একটা সমঝোতা কমিটি গঠন করুন। এই কমিটিতে নিরপেক্ষ সদস্যরা থাকবেন যারা শুনবেন দুই পক্ষের কথা এবং একটা সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
বিরোধ মীমাংসা পদ্ধতি
১. প্রথমে দুই পক্ষকে সরাসরি কথা বলার সুযোগ দিন ২. যদি সমাধান না হয়, তাহলে সমঝোতা কমিটিতে পাঠান ৩. তারপরও সমাধান না হলে কার্যকরী পরিষদের কাছে নিয়ে যান ৪. শেষ অবলম্বন হিসেবে সাধারণ সভায় উপস্থাপন করুন
মনে রাখবেন, বিরোধ যত দ্রুত সমাধান করবেন, তত ভালো। টালবাহানা করলে ছোট সমস্যা বড় হয়ে যায়।
শিক্ষার্থীদের জন্য স্বেচ্ছাসেবা
আপনি যদি একজন শিক্ষার্থী হন, তাহলে স্বেচ্ছাসেবী কাজ আপনার জন্য অসাধারণ সুযোগ।
ক্যারিয়ারের জন্য মূল্যবান অভিজ্ঞতা
একটা সিভিতে “স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছি” লেখা থাকলে সেটা চাকরিদাতাদের চোখে অনেক ভালো দেখায়। এটা প্রমাণ করে যে আপনি দায়িত্বশীল, সমাজসচেতন এবং টিমওয়ার্ক করতে পারেন।
নতুন দক্ষতা অর্জন
স্বেচ্ছাসেবী কাজের মাধ্যমে আপনি শিখবেন:
- যোগাযোগ দক্ষতা
- নেতৃত্ব দক্ষতা
- সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা
- সময় ব্যবস্থাপনা
- টিমওয়ার্ক
নেটওয়ার্কিং সুযোগ
স্বেচ্ছাসেবী কাজে আপনি বিভিন্ন পেশার, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষের সাথে পরিচিত হবেন। এই নেটওয়ার্ক ভবিষ্যতে আপনার অনেক কাজে আসবে।
এনজিও বনাম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
অনেকেই মনে করেন এনজিও আর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন একই জিনিস। আসলে কিছুটা পার্থক্য আছে।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন:
- সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাকৃত কাজ
- কোনো বেতন-ভাতা নেই
- স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করে সাধারণত
এনজিও:
- পেশাদার কর্মীরা কাজ করে
- বেতনভুক্ত কর্মী থাকে
- বড় আকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে
- দেশি-বিদেশি তহবিল নিয়ে কাজ করে
তবে দুটোই সমাজসেবায় নিয়োজিত, সেটা মনে রাখবেন।
বিদেশি তহবিল: সুযোগ এবং সতর্কতা
কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদেশি তহবিল নিয়ে কাজ করে। এটা একটা ভালো সুযোগ বড় প্রকল্প করার জন্য, কিন্তু কিছু নিয়ম আছে।
এনজিও বিষয়ক ব্যুরো
বাংলাদেশে বিদেশি তহবিল নিতে হলে আপনাকে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধন করতে হবে। এটা আলাদা একটা প্রক্রিয়া, সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনের পরে।
স্বচ্ছতা বজায় রাখুন
বিদেশি তহবিল নিলে আরো বেশি স্বচ্ছতা দরকার। সব হিসাব-নিকাশ খোলাখুলি রাখতে হবে। কোথা থেকে টাকা আসছে, কোথায় খরচ হচ্ছে সব কিছু পরিষ্কার হতে হবে।
আধুনিক যুগে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
আমরা এখন ডিজিটাল যুগে বাস করছি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকেও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া
ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম এগুলো ব্যবহার করুন আপনার কাজ প্রচারের জন্য। মানুষ এখন এসব প্ল্যাটফর্মে বেশি সময় কাটায়। একটা ভালো সোশ্যাল মিডিয়া উপস্থিতি আপনার সংগঠনকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে।
অনলাইন ফান্ডরেইজিং
এখন অনলাইনে ডোনেশন নেওয়া অনেক সহজ। বিকাশ, নগদ, রকেট এসব মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করে আপনি সহজেই অনুদান সংগ্রহ করতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন, প্রতিটি টাকার হিসাব রাখা জরুরি।
ডিজিটাল রেকর্ড রাখা
কাগজের ফাইল হারিয়ে যেতে পারে, পুড়ে যেতে পারে। কিন্তু ডিজিটাল রেকর্ড সংরক্ষণ করলে সেটা নিরাপদ থাকে। গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্স এসব ব্যবহার করুন।
সংগঠন টিকিয়ে রাখার কৌশল
একটা সংগঠন শুরু করা সহজ, কিন্তু টিকিয়ে রাখা কঠিন। আমি যে সব সফল সংগঠন দেখেছি, তাদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে।
নিয়মিত কার্যক্রম
মাঝে মাঝে একটা-দুইটা কর্মসূচি করলে হবে না। নিয়মিত, ধারাবাহিক কার্যক্রম থাকতে হবে। মানুষ তখনই যুক্ত থাকবে যখন তারা দেখবে সংগঠন সক্রিয়।
স্বেচ্ছাসেবক ধরে রাখা
নতুন স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া যতটা গুরুত্বপূর্ণ, পুরনো স্বেচ্ছাসেবকদের ধরে রাখাও ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কাজের স্বীকৃতি দিন, তাদের মূল্য দিন। মাঝে মাঝে একটা ধন্যবাদও অনেক কাজ করে।
স্বীকৃতি এবং পুরস্কার
যারা ভালো কাজ করছে, তাদের স্বীকৃতি দিন। বছরে একবার “সেরা স্বেচ্ছাসেবক” পুরস্কার দিন। সার্টিফিকেট দিন। এগুলো হয়তো টাকায় মাপা যায় না, কিন্তু মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
প্রশিক্ষণ কর্মসূচি
স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করুন। তাদের দক্ষতা বাড়ান। একজন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক অনেক বেশি কার্যকর।
সাধারণ ভুল এবং কীভাবে এড়াবেন
আমি নিজে কিছু ভুল করেছি, অনেক সংগঠনকে ভুল করতে দেখেছি। চলুন কিছু সাধারণ ভুল এবং তাদের সমাধান দেখি।
ভুল ১: অস্পষ্ট লক্ষ্য
অনেক সংগঠনই শুরু করে “আমরা সমাজ সেবা করব” বলে। কিন্তু ঠিক কী করবেন সেটা পরিষ্কার না। এটা বিপজ্জনক। আপনার লক্ষ্য হতে হবে SMART—Specific, Measurable, Achievable, Relevant, Time-bound.
সমাধান: পরিষ্কার, মাপযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করুন।
ভুল ২: একজনের উপর নির্ভরশীলতা
কিছু সংগঠন একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সেই ব্যক্তি না থাকলে সংগঠন অচল হয়ে যায়। এটা ঠিক না।
সমাধান: নেতৃত্ব বিকেন্দ্রীকরণ করুন। একাধিক মানুষকে দায়িত্ব দিন।
ভুল ৩: আর্থিক অস্বচ্ছতা
টাকার হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার না রাখলে মানুষের বিশ্বাস হারাবেন।
সমাধান: প্রতিটি পয়সার হিসাব রাখুন এবং নিয়মিত প্রকাশ করুন।
ভুল ৪: স্বেচ্ছাসেবকদের অবহেলা
মনে রাখবেন, স্বেচ্ছাসেবকরাই আপনার সংগঠনের প্রাণ। তাদের অবহেলা করলে তারা চলে যাবে।
সমাধান: তাদের মূল্য দিন, শুনুন, সম্মান করুন।
মিশন এবং ভিশনের মধ্যে পার্থক্য
অনেকেই মিশন আর ভিশনকে গুলিয়ে ফেলে। আসলে এদের মধ্যে পার্থক্য আছে।
ভিশন: স্বপ্ন দেখুন
ভিশন হলো আপনার দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন। আপনি কোথায় পৌঁছাতে চান? যেমন: “একটা শিক্ষিত সমাজ গড়া যেখানে প্রতিটি শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাবে।”
মিশন: কীভাবে পৌঁছাবেন
মিশন হলো আপনার ভিশনে পৌঁছানোর পথ। আপনি ঠিক কী করবেন? যেমন: “দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ এবং টিউটোরিয়াল প্রদান করা।”
সংগঠন বিলুপ্তি
কখনো কখনো একটা সংগঠন বন্ধ করতে হয়। এটা দুঃখজনক, কিন্তু সেটাও পরিকল্পিতভাবে করতে হয়।
কখন বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নেবেন?
- লক্ষ্য অর্জিত হয়ে গেলে
- আর্থিক সংকটের কারণে চালানো সম্ভব না হলে
- সদস্যদের অংশগ্রহণ কমে গেলে
- আইনগত সমস্যা দেখা দিলে
সম্পত্তি বিতরণ
সংগঠন বন্ধ করার সময় সম্পত্তি কোথায় যাবে সেটা গঠনতন্ত্রে লেখা থাকা উচিত। সাধারণত অন্য কোনো সমাজসেবী সংস্থাকে দেওয়া হয় বা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তরুণদের জন্য বিশেষ পরামর্শ
আপনি যদি একজন তরুণ হন এবং একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুরু করতে চান, তাহলে কিছু পরামর্শ দিই।
ছোট থেকে শুরু করুন
একদম শুরুতেই বিশাল প্রকল্প হাতে নেবেন না। ছোট কিছু দিয়ে শুরু করুন। যেমন, পাড়ার শিশুদের জন্য সপ্তাহে একদিন পড়ানো। ধীরে ধীরে বাড়ান।
অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিন
যারা আগে থেকে এই কাজে জড়িত, তাদের কাছ থেকে শিখুন। তাদের ভুল থেকে আপনি শিখতে পারবেন।
ধৈর্য রাখুন
রাতারাতি সফল হবেন না। সময় লাগবে। হতাশ হবেন না। ধৈর্য ধরে এগিয়ে যান।
আত্মবিশ্বাস রাখুন
মানুষ হয়তো বলবে, “তোমার বয়স কম, এসব কাজ তোমার দিয়ে হবে না।” তাদের কথায় কান দেবেন না। আত্মবিশ্বাস রাখুন।
আইনি দিক: জানা জরুরি
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালাতে হলে কিছু আইনি বিষয় জানা দরকার।
১৯৬১ সালের অধ্যাদেশ
বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নিয়ন্ত্রণের মূল আইন হলো স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ, ১৯৬১। এই আইনটা ভালো করে পড়ুন।
নিয়মিত রিপোর্ট জমা
নিবন্ধনের পর বছরে একবার আপনার কার্যক্রম এবং আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে হবে সমাজসেবা অধিদপ্তরে। এটা বাধ্যতামূলক। না করলে নিবন্ধন বাতিল হতে পারে।
ট্যাক্স সুবিধা
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো কিছু ট্যাক্স সুবিধা পায়। তবে সেটার জন্য নির্ধারিত প্রক্রিয়া আছে। একজন হিসাবরক্ষকের পরামর্শ নিন।
বাস্তব উদাহরণ
আমার এক বন্ধু রহিম, ঢাকায় একটা ছোট্ট স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শুরু করেছিল ২০১৮ সালে। শুরুতে মাত্র ৫ জন সদস্য ছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিল রাস্তার শিশুদের পড়াবে।
প্রথম বছর খুব কষ্ট হয়েছিল। কোনো তহবিল ছিল না, জায়গা ছিল না। তারা একটা পার্কে বসে পড়াতো। কিন্তু তারা হাল ছাড়েনি।
পরিষ্কার লক্ষ্য ছিল, সততা ছিল, নিবেদন ছিল। আস্তে আস্তে মানুষ তাদের কাজ দেখল। কেউ বই দিল, কেউ খাতা-কলম দিল, কেউ জায়গা দিল।
আজ ২০২৫ সালে সেই সংগঠনের ২০০+ স্বেচ্ছাসেবক আছে। তারা ঢাকার ৫টা এলাকায় ৫০০+ শিশুকে পড়াচ্ছে। কিছু শিশু এখন কলেজে পড়ছে।
এই গল্পটা আমি বললাম আপনাকে অনুপ্রাণিত করতে। আপনিও পারবেন, যদি আপনার থাকে সঠিক নীতিমালা এবং আন্তরিকতা।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালানো মানে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া।
| চ্যালেঞ্জ | সমাধান |
|---|---|
| তহবিল সংকট | স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে যান, ছোট ছোট অনুদান সংগ্রহ করুন, ক্রাউডফান্ডিং ব্যবহার করুন |
| স্বেচ্ছাসেবক পাওয়া কঠিন | সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকুন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করুন |
| সময় ব্যবস্থাপনা | কাজের সুস্পষ্ট সময়সূচি তৈরি করুন |
| অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব | নিয়মিত সভা করুন, খোলাখুলি আলোচনা করুন |
| স্বীকৃতির অভাব | ছোট ছোট সাফল্যগুলো উদযাপন করুন, মিডিয়ায় প্রচার করুন |
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
একটা সংগঠন শুধু বর্তমান নিয়ে থাকলে চলে না। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা থাকতে হবে।
৫ বছরের পরিকল্পনা করুন
আগামী ৫ বছরে আপনি কোথায় দেখতে চান আপনার সংগঠনকে? কতজন স্বেচ্ছাসেবক চান? কত মানুষের কাছে পৌঁছাতে চান? লিখে রাখুন।
নতুন এলাকায় সম্প্রসারণ
যদি আপনার এলাকায় ভালো কাজ হচ্ছে, তাহলে অন্য এলাকায় যান। তবে মনে রাখবেন, মান বজায় রেখে সম্প্রসারণ করতে হবে।
প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ান
এআই, অ্যাপ, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এগুলো ব্যবহার করে আপনার কাজ আরো কার্যকর করতে পারবেন।
শেষ কথা
তো বন্ধুরা, এই ছিল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নীতিমালা নিয়ে আমার বিস্তারিত আলোচনা। আমি জানি, অনেক তথ্য একসাথে। কিন্তু ঘাবড়াবেন না।
মনে রাখবেন, প্রতিটি বড় সংগঠনই ছোট থেকে শুরু হয়েছিল। প্রতিটি সফল নেতাও প্রথমে নতুন ছিল। আপনিও পারবেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো শুরু করুন। চিন্তা করতে করতে বছর পার হয়ে যাবে। আজই একটা ছোট পদক্ষেপ নিন।
আর হ্যাঁ, নীতিমালা মেনে চলুন। সততা রাখুন। স্বচ্ছতা বজায় রাখুন। মানুষের বিশ্বাস অর্জন করুন। তাহলেই আপনার সংগঠন সফল হবে।
আপনার পালা এখন
আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি আজ থেকে এক মাসের মধ্যে একটা ছোট্ট স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ শুরু করুন। হতে পারে সেটা আপনার এলাকার কয়েকটা শিশুকে পড়ানো, হতে পারে বৃদ্ধদের সেবা করা, হতে পারে পরিবেশ পরিষ্কার রাখা।
যা-ই করুন না কেন, আন্তরিকভাবে করুন। এবং এই নিবন্ধে যে নীতিমালাগুলো আলোচনা করলাম, সেগুলো মাথায় রাখুন।
আপনার সাফল্যের গল্প শুনতে আগ্রহী আমি। কমেন্টে জানান, আপনি কী করতে চাইছেন। একসাথে আমরা একটা সুন্দর সমাজ গড়ব।
মনে রাখবেন “একতায় শক্তি, সংঘবদ্ধতায় সাফল্য।”
শুভকামনা রইল আপনার স্বেচ্ছাসেবী যাত্রায়!
ট্যাগ: #স্বেচ্ছাসেবীসংগঠন #নীতিমালা #সামাজিকসংগঠন #বাংলাদেশ #স্বেচ্ছাসেবা #এনজিও #সমাজসেবা #গঠনতন্ত্র #সংগঠনপরিচালনা #স্বেচ্ছাসেবক