আপনারা কয়েকজন বন্ধু মিলে হয়তো ভাবছেন এলাকার পথশিশুদের জন্য কিছু করবেন, কিংবা পরিবেশ রক্ষায় জনসচেতনতা বাড়াবেন। দারুণ উদ্যোগ! এমন মহৎ চিন্তা থেকেই বড় বড় সামাজিক পরিবর্তনের শুরু হয়। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানেন? শুধু ভালো ইচ্ছা আর আবেগ দিয়ে একটি সংগঠনকে বেশিদিন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। এর জন্য দরকার একটি মজবুত কাঠামো, একটি শক্তিশালী দল আর কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন। আর এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি সুগঠিত কমিটি।
অনেকেই “কমিটি গঠন” শব্দটা শুনলেই ভয় পেয়ে যান। মনে করেন, এটা হয়তো অনেক জটিল আর ঝামেলার কাজ। সত্যি বলতে, বিষয়টা ততটা কঠিন নয় যতটা আপনি ভাবছেন। আমি আপনাকে খুব সহজ ভাষায় ধাপে ধাপে বুঝিয়ে দেবো, কীভাবে একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করে আপনার সামাজিক উদ্যোগকে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন। চলুন, শুরু করা যাক!
কেন একটি ভালো কমিটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
ভাবুন তো, একটা জাহাজ চলছে কিন্তু তার কোনো ক্যাপ্টেন বা নাবিক নেই। জাহাজটি কি তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে? পারবে না। একটি সংগঠনও ঠিক তেমনই একটি জাহাজ, আর কমিটি হলো তার ক্যাপ্টেন ও নাবিকদের দল। একটি ভালো কমিটি:
- লক্ষ্য নির্ধারণ করে: সংগঠনটি কী চায় এবং কীভাবে সেখানে পৌঁছাবে, তার একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ তৈরি করে।
- দায়িত্ব ভাগ করে দেয়: এতে কারো একার উপর চাপ পড়ে না এবং প্রত্যেকেই নিজের সেরাটা দিতে পারে।
- সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে: সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে সকল সদস্যকে অবগত রাখে।
- সদস্যদের উৎসাহিত করে: একটি ভালো নেতৃত্ব পুরো দলকে একসাথে বেঁধে রাখে এবং লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, কমিটি গঠন কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়, এটি একটি সংগঠনের প্রাণ।
সামাজিক সংগঠনের কমিটি গঠনের নিয়ম
যেকোনো সামাজিক সংগঠন, তা ছোট হোক বা বড়, তার কমিটি গঠনের জন্য কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে কাজটি অনেক সহজ হয়ে যায়। চলুন, পুরো প্রক্রিয়াটিকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করে নিই।
লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং একটি নাম ঠিক করা
কমিটি গঠনের আগে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, আপনারা কেন সংগঠনটি তৈরি করতে চান তা পরিষ্কার করা।
- আলোচনা করুন: আপনারা একসঙ্গে বসুন। নিজেদের জিজ্ঞাসা করুন, “আমরা কী অর্জন করতে চাই?” আপনাদের লক্ষ্য কি শিক্ষামূলক, পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক নাকি অন্য কিছু?
- উদ্দেশ্য লিখুন: আপনাদের আলোচনার উপর ভিত্তি করে সংগঠনের প্রধান ৩-৪টি উদ্দেশ্য কাগজে-কলমে লিখে ফেলুন। যেমন: “আমাদের উদ্দেশ্য হলো এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করা।”
- একটি সুন্দর নাম বাছাই করুন: এমন একটি নাম ঠিক করুন যা আপনাদের সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে এবং সহজে মনে রাখা যায়।
এই ধাপটি হলো আপনার সংগঠনের ভিত্তি। এই ভিত্তি যত মজবুত হবে, আপনার সংগঠন তত টেকসই হবে।
একটি খসড়া গঠনতন্ত্র তৈরি করা
গঠনতন্ত্র বা সংবিধান হলো একটি সংগঠনের বাইবেল। এতে সংগঠনের সমস্ত নিয়মকানুন স্পষ্টভাবে লেখা থাকে। ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের মতবিরোধ বা সমস্যা সমাধানে এই গঠনতন্ত্রই আপনার প্রধান হাতিয়ার হবে।
একটি আদর্শ সামাজিক সংগঠনের গঠনতন্ত্র-এ সাধারণত নিচের বিষয়গুলো থাকা উচিত:
- সংগঠনের নাম ও ঠিকানা
- সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
- সদস্য হওয়ার যোগ্যতা ও নিয়মাবলী
- সদস্যদের অধিকার ও দায়িত্ব
- কমিটির বিভিন্ন পদের নাম, সংখ্যা এবং তাদের कार्यপরিধি
- কমিটি নির্বাচন পদ্ধতি
- সভার নিয়মকানুন (সাধারণ সভা, কার্যকরী কমিটির সভা ইত্যাদি)
- আর্থিক ব্যবস্থাপনার নিয়ম (তহবিল সংগ্রহ, হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ)
- গঠনতন্ত্র সংশোধন করার পদ্ধতি
একটি খসড়া তৈরি করে পরবর্তীতে সবার মতামত নিয়ে তা চূড়ান্ত করতে পারেন।
একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা
মূল কমিটি নির্বাচনের আগে সংগঠনের প্রাথমিক কাজগুলো গুছিয়ে আনার জন্য একটি অস্থায়ী বা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রধান কাজ হলো:
- সদস্য সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করা।
- গঠনতন্ত্রের খসড়া চূড়ান্ত করা।
- একটি সাধারণ সভার আয়োজন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
আহ্বায়ক কমিটি সাধারণত ছোট হয়, যেমন ৩, ৫ বা ৭ সদস্যের। এখানে একজন আহ্বায়ক (Convener) এবং কয়েকজন সদস্য (Member) থাকেন।
সাধারণ সভা ডাকা এবং কমিটি নির্বাচন
এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আহ্বায়ক কমিটি সংগঠনের সকল প্রাথমিক সদস্যকে নিয়ে একটি সাধারণ সভার আয়োজন করবে।
- সভার নোটিশ: ৭-১৫ দিন আগে সকল সদস্যকে সভার তারিখ, সময়, স্থান এবং আলোচ্যসূচি লিখিতভাবে জানাতে হবে।
- আলোচ্যসূচি: সাধারণ সভার মূল আলোচ্যসূচি থাকে – গঠনতন্ত্র অনুমোদন এবং কার্যকরী কমিটি নির্বাচন।
- নির্বাচন: নির্বাচন গণতান্ত্রিক উপায়ে হওয়া উচিত। এটি সরাসরি ভোটের মাধ্যমে হতে পারে বা সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে মনোনয়ন চূড়ান্ত হতে পারে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য ৩ সদস্যের একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যারা পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করবেন।
কার্যকরী কমিটি বা পরিষদ (Executive Committee)
সাধারণ সভায় সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত কমিটিই হলো কার্যকরী কমিটি। এই কমিটিই নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য (সাধারণত ১ বা ২ বছর) সংগঠনের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে।
একটি আদর্শ কমিটিতে সাধারণত নিম্নলিখিত পদগুলো থাকে। আসুন, একটি টেবিলের মাধ্যমে তাদের কাজগুলো সংক্ষেপে জেনে নিই।
| পদ (Position) | প্রধান দায়িত্ব (Key Responsibilities) |
| সভাপতি (President) | সংগঠনের প্রধান। সকল সভায় সভাপতিত্ব করা এবং সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দেওয়া। |
| সহ-সভাপতি (Vice President) | সভাপতির অনুপস্থিতিতে তার দায়িত্ব পালন করা এবং তাকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করা। |
| সাধারণ সম্পাদক (General Secretary) | সংগঠনের প্রধান নির্বাহী। সকল কার্যক্রম পরিচালনা, সভা আহ্বান এবং যোগাযোগ রক্ষা করা। |
| যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক (Joint Secretary) | সাধারণ সম্পাদককে সহযোগিতা করা এবং তার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করা। |
| কোষাধ্যক্ষ (Treasurer) | সংগঠনের আর্থিক হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ, বাজেট তৈরি এবং তহবিল পরিচালনা করা। |
| সাংগঠনিক সম্পাদক (Organizing Secretary) | সংগঠনকে শক্তিশালী করা, সদস্য সংগ্রহ এবং বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন করা। |
| প্রচার সম্পাদক (Publicity Secretary) | সংগঠনের কার্যক্রম সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা। |
| দপ্তর সম্পাদক (Office Secretary) | সংগঠনের দাপ্তরিক কাজ, চিঠিপত্র এবং রেকর্ডপত্র রক্ষণাবেক্ষণ করা। |
| কার্যকরী সদস্য (Executive Member) | কমিটির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা এবং অর্পিত দায়িত্ব পালন করা। |
মনে রাখবেন: সংগঠনের আকার এবং কাজের পরিধি অনুযায়ী পদের সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে। মূল বিষয় হলো, দায়িত্বগুলো যেন সঠিকভাবে বন্টন করা হয়।
দায়িত্ব হস্তান্তর এবং কার্যক্রম শুরু
নির্বাচনের পর আহ্বায়ক কমিটি নতুন কমিটির কাছে সমস্ত কাগজপত্র, হিসাব এবং দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করবে। এরপর নতুন কমিটির প্রথম কাজ হবে একটি কার্যকরী কমিটির সভা ডেকে নিজেদের মধ্যে পরিচিত হওয়া এবং আগামী দিনের জন্য একটি কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি করা।
নিবন্ধন (Registration): কেন এবং কিভাবে?
আপনার সংগঠনটি যদি দীর্ঘমেয়াদে বড় পরিসরে কাজ করতে চায়, তাহলে সরকারি নিবন্ধন থাকা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশে সাধারণত সমাজসেবা অধিদপ্তর বা জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস-এর নিবন্ধকের কার্যালয় (RJSC) থেকে সামাজিক সংগঠনের নিবন্ধন করা যায়।
নিবন্ধনের সুবিধা:
- আইনি স্বীকৃতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে।
- ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা সহজ হয়।
- সরকারি ও বেসরকারি অনুদান পেতে সুবিধা হয়।
নিবন্ধন প্রক্রিয়া একটু সময়সাপেক্ষ হতে পারে, তাই অভিজ্ঞ কারো পরামর্শ নিতে পারেন।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQs)
প্রশ্ন: একটি আদর্শ কমিটির সদস্য সংখ্যা কত হওয়া উচিত?
উত্তর: এর কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তবে কমিটি বেশি বড় হলে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়, আবার খুব ছোট হলে কাজের চাপ বেড়ে যায়। সাধারণত, ছোট সংগঠনের জন্য ৭-১১ জনের কমিটি এবং বড় সংগঠনের জন্য ১৫-২১ জনের কমিটি আদর্শ বলে মনে করা হয়। মূল বিষয় হলো কার্যকারিতা।
প্রশ্ন: কমিটির মেয়াদ কতদিন হওয়া উচিত?
উত্তর: সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটির মেয়াদ নির্ধারিত হয়। সাধারণত, বাংলাদেশে বেশিরভাগ সামাজিক সংগঠনের কমিটির মেয়াদ ১ বছর বা ২ বছর হয়ে থাকে।
প্রশ্ন: সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য কী যোগ্যতা প্রয়োজন?
উত্তর: গঠনতন্ত্রে শিক্ষাগত বা অন্য কোনো যোগ্যতার উল্লেখ না থাকলে, সাধারণত সংগঠনের সক্রিয়, অভিজ্ঞ এবং নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলী সম্পন্ন যেকোনো সদস্যই এই পদের জন্য প্রার্থী হতে পারেন। মূল যোগ্যতা হলো সংগঠনের প্রতি আন্তরিকতা এবং সময় দেওয়ার মানসিকতা।
উপসংহার
একটি সংগঠন গড়ে তোলা অনেকটা একটি চারা গাছ লাগানোর মতো। সঠিক পরিচর্যা করলে একদিন সেই গাছ বড় হয়ে ফল দেয়, ছায়া দেয়। আর একটি সুগঠিত কমিটি হলো সেই গাছের পরিচর্যা করার মালির মতো।
আশা করি, এই বিস্তারিত আলোচনা আপনার সকল দ্বিধা দূর করতে পেরেছে। সামাজিক সংগঠনের কমিটি গঠনের নিয়ম গুলো অনুসরণ করে আপনি এবং আপনার বন্ধুরা মিলে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সংগঠন গড়ে তুলতে পারবেন। মনে রাখবেন, একটি ভালো দল যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।
আপনারা কি কখনো কোনো কমিটি গঠনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন? নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করুন, যেন অন্যরাও আপনার কাছ থেকে শিখতে পারে!