যে সমুদ্রে ডোবা অসম্ভব

পৃথিবীতে এমন একটি সমুদ্র আছে যেখানে ডুবে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। যারা সাঁতার জানেন না, তাদের জন্য এটি স্বর্গের মতো একটি জায়গা। এই অবিশ্বাস্য স্থানটির নাম ডেড সি বা মৃত সাগর, যা জর্ডানে অবস্থিত।

পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু স্থল

জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে মাত্র ৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই অসাধারণ সমুদ্রটি। ডেড সি পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু স্থলভাগে অবস্থিত – সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৩০ মিটার নিচে। যাত্রা শুরু করার পর থেকে শুধু নিচের দিকেই নামতে হয়, যা একটি অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি করে।

আম্মানে যেখানে তাপমাত্রা থাকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সেখানে ডেড সি এলাকায় তাপমাত্রা পৌঁছে যায় ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে বাতাসেও একটি অদ্ভুত লবণের গন্ধ পাওয়া যায়।

লবণের রাজ্য

ডেড সি-এর তীরে পৌঁছে যা চোখে পড়ে তা বিস্ময়কর। সাধারণ সমুদ্রের তীরে যেখানে বালু থাকে, সেখানে এখানে শুধু লবণ আর লবণ। মাটিতে স্তরে স্তরে জমে আছে লবণের বিশাল পিণ্ড। কোথাও লবণ জমে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে, কোথাও আবার তৈরি হয়েছে লবণের স্ফটিক।

প্রতিটি লবণের পিণ্ডের নকশা ভিন্ন – কোথাও রেখা রেখা, কোথাও গোলাকার। দেখে মনে হয় যেন মাটির উপর কেউ মুক্তা বা সাদা হীরা ছড়িয়ে দিয়েছে। বৃষ্টি হলে এই পিণ্ডগুলো নরম হয়ে যায়, আবার শুকিয়ে গেলে নতুন আকারে জমে ওঠে।

লবণাক্ততার রেকর্ড

ডেড সি-কে লবণাক্ত সাগরও বলা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য সমুদ্রে যেখানে লবণের পরিমাণ মাত্র ৩.৫%, সেখানে ডেড সি-তে লবণের পরিমাণ ৩৪% – অর্থাৎ দশ গুণ বেশি!

এত বেশি লবণাক্ততার কারণে এই সমুদ্রে কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না। না মাছ, না ঝিনুক, না শামুক, এমনকি কোনো শৈবালও নেই। যে কারণে এর নাম হয়েছে ‘মৃত সাগর’।

ভাসার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা

পানি দেখতে ফিরোজা নীল রঙের এবং একেবারে তেলের মতো ঘন। উপরে ভ্যাসলিনের মতো একটি পরত থাকে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সাধারণ পানিতে ডিম ডুবে গেলেও ডেড সি-এর পানিতে ডিম ভেসে থাকে।

আর মানুষের ক্ষেত্রে? কোনো সাঁতার না কেটেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেসে থাকা যায়! হাত-পা উপরে তুলে দিলেও ডোবা যায় না। এটি সত্যিই আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি।

সতর্কতা প্রয়োজন

তবে এই অভিজ্ঞতা নেওয়ার সময় সাবধান থাকতে হয়। পানি অত্যন্ত লবণাক্ত হওয়ায় চোখে বা মুখে গেলে প্রচণ্ড জ্বালা করে। তীরে লবণের স্ফটিকগুলো এত ধারালো যে পায়ে কেটে যেতে পারে, তাই চটি পরে নামা ভালো।

শরীরে কোনো কাটা বা আঁচড় থাকলে সেখানে তীব্র জ্বালাপোড়া হয়। পানি থেকে উঠে এলে ত্বক শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়, টান টান অনুভূত হয়। গলা শুকিয়ে যায় এবং প্রচুর পানি পান করার প্রয়োজন হয়।

ত্বকের জন্য উপকারী

এই পানি পৃথিবীর সবচেয়ে খনিজ সমৃদ্ধ পানি। এখানকার মাটিতে আছে ব্রোমিন, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়াম। বলা হয় যে ত্বকের রোগ যেমন একজিমা বা চুলকানির জন্য এই পানি অত্যন্ত উপকারী। এই মাটি দিয়ে তৈরি ফেস মাস্ক পুরো বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত।

বিলুপ্তির পথে

দুঃখজনক সত্য হলো, ডেড সি আসলেই ‘মৃত’ হয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে এর পানি কমে যাচ্ছে। ডেড সি জর্ডান নদী থেকে পানি পায়, কিন্তু এই নদীর পাশে বসতি বৃদ্ধি, কৃষিকাজ এবং কারখানায় অতিরিক্ত পানি ব্যবহারের কারণে ডেড সি আর পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। তাছাড়া কড়া রোদ ও তাপে পানি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, আর ৫০ থেকে ১০০ বছর পরে এই পৃথিবীর বুকে ডেড সি বলতে আর কিছুই থাকবে না। আগে যেখানে পানি ছিল, এখন সেই জায়গা শুকিয়ে অনেক দূরে সরে গেছে।

স্থানীয় সংস্কৃতি

ডেড সি ভ্রমণের পর জর্ডানের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘ওজি ল্যাম্ব’ চেখে দেখা যেতে পারে। এটি বেদুইনদের স্টাইলে রান্না করা একটি বিশেষ খাবার। ভেড়ার মাংস দীর্ঘক্ষণ ধীরে ধীরে রান্না করা হয়, যাতে মাংস একদম নরম হয়ে যায়। সাথে থাকে বাসমতি চাল, গাজর, বরবটি এবং বাদাম দিয়ে তৈরি বিশেষ ভাত।

উপসংহার

ডেড সি পৃথিবীর এক অনন্য প্রাকৃতিক বিস্ময়। এটি শুধু একটি পর্যটন স্থান নয়, আল্লাহর সৃষ্টির এক অপূর্ব নিদর্শন। যারা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় এবং নতুন অভিজ্ঞতা নিতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি একটি অবশ্য দর্শনীয় স্থান।

তবে মনে রাখতে হবে, এই অনন্য স্থানটি হয়তো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য থাকবে না। তাই সুযোগ থাকতে এই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা নেওয়া উচিত। যেখানে ডোবা অসম্ভব, যেখানে প্রকৃতি তার এক অনন্য রূপে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে – সেই ডেড সি সত্যিই এক অবিস্মরণীয় গন্তব্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top