যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত এবং বিতর্কিত কূটনৈতিক জোটগুলোর একটি। এই সম্পর্ক শুধুমাত্র দুটি দেশের মধ্যকার মিত্রতা নয়, বরং এটি ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং ধর্মীয় অনুভূতির এক জটিল মিশ্রণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপের জন্য ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমানে এই সম্পর্ক আর শুধু সরকারি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। ইসরায়েলপন্থী বিভিন্ন লবি গ্রুপ মার্কিন রাজনীতি এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো যুক্তরাষ্ট্র কেন ইসরায়েলকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং কীভাবে ইসরায়েলপন্থী সংগঠন মার্কিন রাজনীতিকে প্রভাবিত করে।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থন করার মূল কারণসমূহ
১. মূল্যবোধের সাদৃশ্য (Shared Values)
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল উভয় দেশই গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধে বিশ্বাস করে বলে দাবি করা হয়। দুই দেশের মধ্যে এই মূল্যবোধের সাদৃশ্য তাদের দীর্ঘমেয়াদী মিত্রতার একটি প্রধান ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।
২. কৌশলগত সামরিক আউটপোস্ট
মধ্যপ্রাচ্যের মতো অস্থিতিশীল এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র একটি অত্যন্ত জরুরি সামরিক আউটপোস্ট হিসেবে ব্যবহার করে। এই অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব এবং গোয়েন্দা তৎপরতা বজায় রাখার জন্য ইসরায়েলের ভূমিকা অপরিহার্য।
৩. হলোকাস্ট এবং নৈতিক দায়বদ্ধতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া হলোকাস্টের ভয়াবহতার জন্য পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, এক ধরনের নৈতিক দায়বদ্ধতা কাজ করে। এই অনুভূতি দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন রাজনীতিতে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের একটি মানসিক ভিত্তি তৈরি করেছে।
৪. ঔপনিবেশিক ইতিহাসের সাদৃশ্য
এমন একটি সত্য যা কেউ প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চায় না তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল উভয় দেশই স্থানীয় আদিবাসীদের জাতিগত নিধনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইউরোপীয় অভিবাসীরা যেমন আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, ঠিক একইভাবে ইসরায়েলি শক্তি ফিলিস্তিনিদের ওপর দীর্ঘ ৭৬ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিপীড়ন চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ঐতিহাসিক সাদৃশ্য দুই দেশের মধ্যে একটি অলিখিত বন্ধন তৈরি করেছে।
AIPAC: মার্কিন রাজনীতির অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক
AIPAC কী এবং এর প্রভাব কতটা শক্তিশালী?
American Israel Public Affairs Committee বা সংক্ষেপে AIPAC হলো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ইসরায়েলপন্থী লবি সংগঠন। এই সংস্থাটি ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায় এমন সব কার্যক্রম পরিচালনা করে যা অনেক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থের বিপরীতেও যায়।
AIPAC কীভাবে মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করে?
আইনি কারণে AIPAC সরাসরি রাজনৈতিক অনুদান দিতে পারে না। তবে বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের খুব কম রাজনীতিবিদই আছেন যারা AIPAC-এর আর্থিক সহায়তা ছাড়া নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
নির্বাচনের আগে AIPAC এমন সব প্রার্থীকে বাছাই করে যারা বিনা শর্তে ইসরায়েলকে সমর্থন করে এবং তাদের নির্বাচিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। অন্যদিকে, যে সকল রাজনীতিবিদ ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদেরকে AIPAC এমনভাবে বাধাগ্রস্ত করে যেন তারা আর কখনো নির্বাচনে জিততে না পারে। এই বিষয়টি AIPAC তাদের প্রচারণামূলক ভিডিওতে প্রকাশ্যে ঘোষণাও করেছে।
AIPAC এর নেটওয়ার্ক এবং প্রভাব বিস্তারের কৌশল
AIPAC শুধু কংগ্রেস বা রাষ্ট্রপতি প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করে না। তারা একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে যার মাধ্যমে ইসরায়েল সংক্রান্ত বিষয়কে মার্কিন ঘরোয়া রাজনীতির ‘domestic issue’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
গত অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে AIPAC মার্কিন সরকারি ব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছে যার মূল উদ্দেশ্যই হলো ইসরায়েলকে বিনা শর্তে সমর্থন করা। ইসরায়েল যেকোনো ধরনের অপরাধ করুক না কেন, সেটি মার্কিন রাজনীতিবিদদের দেখার বিষয় নয়। তাদের কাজ হলো AIPAC-এর সহায়তা গ্রহণ করা এবং বিনিময়ে ইসরায়েলের সকল কার্যক্রমকে বৈধতা প্রদান করা।
দ্বিদলীয় রাজনীতিতে AIPAC এর একচেটিয়া প্রভাব
ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় দলেই AIPAC এর কর্তৃত্ব
যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে—একদিকে ডেমোক্র্যাটিক দল, অন্যদিকে রিপাবলিকান। কিন্তু AIPAC-এর কাছে এমন কোনো দলীয় ভেদাভেদ নেই। তারা উভয় দলকেই সমানভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এবং তাদের পকেটে রাখে।
AIPAC এতটাই প্রভাবশালী যে তাদের বার্ষিক সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প, জো বাইডেন, কমলা হ্যারিস, হিলারি ক্লিনটনের মতো শীর্ষ রাজনীতিবিদরা নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন এবং প্রকাশ্যে বক্তৃতা দেন।
AIPAC এর আর্থিক বিনিয়োগ
রাজনৈতিক অঙ্গনে AIPAC-এর সরাসরি অনুদানের ব্যাপারে কিছু বিধিনিষেধ থাকলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী রাজনীতিতে শত কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, AIPAC মার্কিন সমাজের নানা স্তরে এমনভাবে গ্রথিত হয়ে গেছে যে তারা সরাসরি নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়া বাইপাস করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে পারে।
ইসরায়েল এখন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ
AIPAC এবং অন্যান্য ইসরায়েলপন্থী সংগঠনের প্রচেষ্টায় ইসরায়েল সংক্রান্ত বিষয় এখন আর শুধু বিদেশ নীতি নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।
এর প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে পর্যন্ত প্রার্থীদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় তারা নির্বাচনে জয়লাভের পরে ইসরায়েল সফর করবে কিনা। এটি একটি স্থানীয় নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েল বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নীতিনির্ধারকদের দ্বৈত আনুগত্য
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতিনির্ধারক এমন আচরণ করেন যেন তারা নিজেরাই প্রো-ইসরায়েল লবিস্ট। উদাহরণস্বরূপ, জর্জ বুশ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার দ্বৈত নাগরিকত্ব ছিল এবং তারা ইসরায়েলি সংস্থা বা কোম্পানির হয়ে কাজ করতেন।
তারা একইসাথে ইসরায়েল সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন এবং নেতানিয়াহুর মতো নেতাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। অথচ মার্কিন মিডিয়ার মাধ্যমে তারা সাধারণ আমেরিকান হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতেন।
অন্য দেশের লবিস্টদের সাথে তুলনা
মাত্র কয়েক মাস আগে একজন লবিস্টকে কানাডার পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু AIPAC এর চেয়েও বহু গুণ বেশি প্রভাবশালী কার্যক্রম প্রকাশ্যে পরিচালনা করলেও তাদেরকে বিদেশি রাষ্ট্রের স্বার্থে কাজ করার জন্য কোনো ধরনের আইনি বাধার সম্মুখীন হতে হয় না।
এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে AIPAC শুধু একটি লবি সংগঠন নয়, বরং এটি এমন একটি কাঠামো যা মার্কিন রাজনীতির অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে এবং বহু স্তরে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
AIPAC এর প্রভাবে ট্রাম্পের ইরান হামলা
ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর যখন ইসরায়েল বুঝতে পারে যে একা লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তখন AIPAC-এর মধ্যস্থতায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে সামরিক হামলা পরিচালনা করেন।
সংবিধান লঙ্ঘন এবং নীরব কংগ্রেস
এই হামলা চালানোর সময় ট্রাম্প মার্কিন কংগ্রেসের অনুমতি না নিয়েই যুদ্ধ শুরু করে দেন। নিয়ম অনুযায়ী, একজন প্রেসিডেন্ট ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন না—এজন্য তাকে অবশ্যই কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হয়।
কিন্তু যুদ্ধটি যেহেতু ইসরায়েলের পক্ষে পরিচালিত হয়েছিল, সেজন্য ট্রাম্পের বিরোধী দলও এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি। অথচ এই হামলা যদি অন্য কোনো পশ্চিমা দেশ বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হতো, তাহলে ট্রাম্প রাতারাতি অভিশংসনের (impeachment) শিকার হতেন এবং প্রেসিডেন্ট পদেও থাকতে পারতেন না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট: AIPAC এর পরোক্ষ পুতুল?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আমরা সবাই মনে করি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও পরোক্ষভাবে AIPAC-এর ইশারায় পরিচালিত হন।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক দেশ হলেও বিগত কয়েক দশকে তারা যে সমস্ত যুদ্ধে জড়িত হয়েছে, তার অধিকাংশেই পরাজিত হয়েছে। তারপরও বিশ্বের প্রতিটি সংঘাতে আমেরিকানরা হস্তক্ষেপ করে কেন এবং এই যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে লাভবান হয়—এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়।
উপসংহার
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের সম্পর্ক কেবল দুই মিত্র রাষ্ট্রের মধ্যকার স্বাভাবিক কূটনৈতিক বন্ধন নয়। এটি এমন একটি জটিল সম্পর্ক যেখানে ইসরায়েলপন্থী লবি সংগঠন, বিশেষত AIPAC, মার্কিন রাজনীতির প্রতিটি স্তরে গভীর প্রভাব বিস্তার করে আছে।
AIPAC শুধু নির্বাচনী প্রচারণায় আর্থিক সহায়তা দেয় না, বরং তারা এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে যেখানে ইসরায়েল সংক্রান্ত বিষয় মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে স্থানীয় রাজনীতিবিদ পর্যন্ত সবাই ইসরায়েলের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে বাধ্য হন।
এই সম্পর্ক বিশ্ব রাজনীতিতে একটি অনন্য উদাহরণ, যেখানে একটি ছোট রাষ্ট্র একটি পরাশক্তির নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় এতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এই বাস্তবতা বুঝতে পারলেই মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সংকট এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ নীতির অনেক জটিলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মূল তথ্যসূত্র: এই নিবন্ধটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি এবং মার্কিন-ইসরায়েল সম্পর্কের বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে রচিত। লবি গ্রুপ এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কিত তথ্য বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সংগৃহীত।