ঢাকা, ২৬ আগস্ট ২০২৫: মহাকাশ গবেষণায় আবারও এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সৌরজগতের বাইরে একগুচ্ছ নতুন গ্রহ আবিষ্কার করেছেন, যার মধ্যে কয়েকটি আমাদের পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যেমন নাসার ট্রানজিটিং এক্সোপ্ল্যানেট সার্ভে স্যাটেলাইট (TESS) এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহারের মাধ্যমে এই যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো সম্ভব হয়েছে।
পৃথিবীর মতো গ্রহের খোঁজ
বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি পৃথিবী থেকে প্রায় ১০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত ‘টিওআই ৭০০ ই’ (TOI 700 e) নামক একটি গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন। নাসার টেস স্যাটেলাইট দ্বারা আবিষ্কৃত এই গ্রহটি তার নক্ষত্রের বাসযোগ্য অঞ্চলে (habitable zone) অবস্থান করছে, যেখানে তাপমাত্রা এমন যে পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারে। বিজ্ঞানীদের মতে, এই গ্রহটির আয়তন পৃথিবীর প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং এটি পাথুরে হতে পারে। এর আগে ২০২০ সালে একই নক্ষত্রমণ্ডলে ‘টিওআই ৭০০ ডি’ নামে আরও একটি বাসযোগ্য গ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছিল।
এর পাশাপাশি, যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা নাসার স্যাটেলাইটের তথ্য বিশ্লেষণ করে সৌরজগতের বাইরে পৃথিবীর মতো ৮৫টি নতুন গ্রহ আবিষ্কার করেছেন। এই গ্রহগুলোর আকার এবং তাদের নক্ষত্র থেকে দূরত্ব বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এগুলোর মধ্যে কয়েকটিতে জীবন ধারণের উপযোগী পরিবেশ থাকতে পারে।
বিচিত্র গ্রহ জগৎ
আবিষ্কৃত গ্রহগুলো কেবল পৃথিবীর মতো নয়, বরং বিভিন্ন আকার এবং বৈশিষ্ট্যের। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ‘টিওআই-৬৬৫১বি’ নামে একটি নতুন গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন যা পৃথিবীর চেয়ে প্রায় ৬০ গুণ ভারী। সূর্য থেকে ৬৯০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্রহটির মূল অংশ প্রায় ৮৭ শতাংশ লোহার মতো শক্ত ধাতু দ্বারা গঠিত এবং এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ১,২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এটিকে প্রাণের জন্য প্রতিকূল করে তুলেছে।
অন্যদিকে, ‘এলএইচএস ১১৪০ বি’ নামের একটি “সুপার-আর্থ” বা বরফ-পানির বিশ্ব আবিষ্কৃত হয়েছে, যা পৃথিবীর চেয়ে ১.৭ গুণ বড়। এই গ্রহটিতে মহাসাগর বা মেঘে ঢাকা বায়ুমণ্ডল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এটি একটি লাল বামন নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে।
আবিষ্কারের নেপথ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি
বহিঃসৌরগ্রহ (Exoplanet) আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ট্রানজিট পদ্ধতি এবং রেডিয়াল ভেলোসিটি কৌশল অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। যখন কোনো গ্রহ তার নক্ষত্রের সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, তখন নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা কিছুটা কমে যায়। এই পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা গ্রহের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারেন, যা ট্রানজিট পদ্ধতি নামে পরিচিত। নাসার কেপলার এবং টেস টেলিস্কোপ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে হাজার হাজার গ্রহ আবিষ্কার করেছে।
পাশাপাশি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তিও গ্রহ আবিষ্কারে সহায়তা করছে। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে সৌরজগতের বাইরের একটি অজানা গ্রহের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন, যা মহাকাশ গবেষণায় প্রযুক্তির এক নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি এক্সোপ্ল্যানেট আবিষ্কার করেছেন এবং এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মতো শক্তিশালী যন্ত্রপাতির মাধ্যমে এই গ্রহগুলোর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করে সেখানে প্রাণের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান, যেমন পানি বা মিথেন, আছে কিনা তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
যদিও ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব এখনও নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি, তবে এই আবিষ্কারগুলো মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান এবং প্রাণের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করছে। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা মহাবিশ্বে একাকী নই, এই প্রশ্নের একটি সদুত্তর পাওয়া যাবে।
সূত্রসমূহ:
- NASA’s TESS Discovers Planetary System’s Second Earth-Size World: NASA Jet Propulsion Laboratory
- NASA Planet Hunter Finds its 1st Earth-size Habitable-zone World: NASA
- TOI-700 e – NASA Science: NASA Science
- TOI-700 d – NASA Science: NASA Science
- LHS 1140 b – Wikipedia: Wikipedia
- NASA Exoplanet Archive: NASA Exoplanet Archive