কখনো এমন হয়েছে যে, ফোনের গ্যালারি পরিষ্কার করতে গিয়ে ভুল করে প্রিয় কোনো মুহূর্তের ভিডিও ডিলিট করে ফেলেছেন? হতে পারে সেটা বন্ধুর বিয়ের ভিডিও, পরিবারের সাথে কাটানো কোনো ছুটির দিনের স্মৃতি অথবা আপনার কোনো জরুরি কাজের রেকর্ড। ডিলিট বাটন চাপার পরের মুহূর্তের সেই আফসোসটা আমাদের সবারই কমবেশি পরিচিত। মনে হয়, ইশ! যদি কোনোভাবে ভিডিওটা ফেরত পাওয়া যেত।
আপনার এই আফসোস দূর করতেই আজকের এই লেখা। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন! ডিজিটাল যুগে হারিয়ে যাওয়া মানেই চিরতরে বিদায় নয়। এমন কিছু চমৎকার সফটওয়্যার আছে, যা আপনার ডিলিট হওয়া ভিডিও ফিরিয়ে আনতে পারে জাদুর মতো। চলুন, আজ আমরা সেই জাদুর কাঠিগুলোর সাথেই পরিচিত হব, যা আপনার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে।
ভিডিও ডিলিট হওয়ার পর আসলে কী ঘটে?
আপনি যখন কোনো ফাইল বা ভিডিও ডিলিট করেন, তখন সেটা কিন্তু সাথে সাথেই আপনার ডিভাইস থেকে পুরোপুরি মুছে যায় না। ব্যাপারটা অনেকটা লাইব্রেরির বইয়ের মতো। আপনি যখন কোনো বই লাইব্রেরিকে ফেরত দেন, তখন লাইব্রেরিয়ান বইটাকে শেলফ থেকে সরিয়ে ফেলে না, বরং তার রেজিস্টার খাতায় বইটার নামের পাশে লিখে দেয়, “এই জায়গাটি এখন খালি আছে।” অন্য কেউ নতুন বই রাখতে চাইলে তখন সেই জায়গাটা ব্যবহার করা হয়।
আপনার ফোন বা কম্পিউটারেও ঠিক তাই হয়। অপারেটিং সিস্টেম শুধু ওই জায়গাটাকে “খালি” বা “ব্যবহারযোগ্য” হিসেবে মার্ক করে রাখে। যতক্ষণ পর্যন্ত না ওই খালি জায়গায় নতুন কোনো ডেটা এসে জমা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার পুরনো ভিডিওটি পুনরুদ্ধার করার একটা সুযোগ থাকে।
এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ হলো, ভিডিও ডিলিট হওয়ার সাথে সাথে ওই ডিভাইসটি আর ব্যবহার না করা। কারণ, আপনি যত বেশি ডিভাইসটি ব্যবহার করবেন (যেমন: নতুন ছবি তোলা, অ্যাপ ইনস্টল করা), আপনার পুরনো ডেটার ওপর নতুন ডেটা ওভাররাইট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তত বাড়বে।
সেরা ৫টি ভিডিও রিকভারি সফটওয়্যার
বাজারে অনেক সফটওয়্যার থাকলেও, আমরা আপনার জন্য সেরা এবং নির্ভরযোগ্য ৫টি সফটওয়্যারের একটি তালিকা তৈরি করেছি। চলুন দেখে নেওয়া যাক।
১. Recuva (Windows/PC এর জন্য সেরা)
যদি আপনি কম্পিউটার, এসডি কার্ড বা পেনড্রাইভ থেকে ভিডিও ডিলিট করে ফেলেন, তাহলে Recuva হতে পারে আপনার সেরা বন্ধু। এটি বছরের পর বছর ধরে ডেটা রিকভারির জগতে একটি বিশ্বস্ত নাম। সবচেয়ে বড় কথা, এর একটি শক্তিশালী ফ্রি সংস্করণ রয়েছে!
কেন Recuva ব্যবহার করবেন?
- সম্পূর্ণ ফ্রি: এর ফ্রি সংস্করণটিই সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী।
- সহজ ইন্টারফেস: সফটওয়্যারটি ব্যবহার করা খুবই সহজ। মাত্র কয়েকটি ক্লিকেই আপনি স্ক্যান শুরু করতে পারবেন।
- ডিপ স্ক্যান: সাধারণ স্ক্যানে ভিডিও খুঁজে না পাওয়া গেলে এর ‘ডিপ স্ক্যান’ ফিচারটি ব্যবহার করে অনেক পুরনো ডিলিট হওয়া ফাইলও খুঁজে বের করা সম্ভব।
- ফাইল প্রিভিউ: রিকভার করার আগেই আপনি ভিডিও বা ফাইলটি প্রিভিউ করে দেখতে পারবেন, যা আপনার সময় বাঁচাবে।
কিছু সীমাবদ্ধতা:
- মাঝে মাঝে বড় আকারের বা ক্ষতিগ্রস্ত ভিডিও ফাইল পুরোপুরি রিকভার করতে পারে না।
- এটি মূলত উইন্ডোজ ব্যবহারকারীদের জন্য তৈরি।
২. DiskDigger Photo Recovery (Android এর জন্য সুপারস্টার)
অ্যান্ড্রয়েড ফোন থেকে সরাসরি ভিডিও রিকভার করার জন্য DiskDigger একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় অ্যাপ। গুগল প্লে স্টোরে এর মিলিয়ন মিলিয়ন ডাউনলোডই এর কার্যকারিতার প্রমাণ দেয়।
কেন DiskDigger আপনার ফোনে থাকা উচিত?
- রুট এবং নো-রুট অপশন: আপনার ফোন রুট করা না থাকলেও এটি বেসিক স্ক্যান করতে পারে। তবে রুট করা থাকলে এর কার্যকারিতা বহুগুণে বেড়ে যায় এবং ডিপ স্ক্যান সম্ভব হয়।
- ব্যবহার করা সহজ: অ্যাপটির ইন্টারফেস খুবই সাধারণ। অ্যাপটি খুলে স্ক্যান শুরু করলেই ডিলিট হওয়া ফাইলগুলো আপনার সামনে হাজির হবে।
- ফ্রি সংস্করণ: বেসিক ভিডিও এবং ফটো রিকভারির জন্য এর ফ্রি সংস্করণটিই যথেষ্ট।
- সরাসরি আপলোড: রিকভার করা ফাইলগুলো আপনি সরাসরি গুগল ড্রাইভ, ড্রপবক্স বা ইমেইলে পাঠিয়ে দিতে পারবেন।
কিছু সীমাবদ্ধতা:
- রুট করা না থাকলে শুধুমাত্র লো-রেজোলিউশনের ভিডিও বা ছবির থাম্বনেইল ফেরত আসতে পারে। সেরা ফলাফলের জন্য ফোন রুট করা থাকতে হয়।
৩. EaseUS MobiSaver (Android ও iOS এর জন্য নির্ভরযোগ্য)
EaseUS ডেটা রিকভারি জগতে একটি পরিচিত নাম। তাদের MobiSaver অ্যাপটি বিশেষভাবে মোবাইল ব্যবহারকারীদের জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি অ্যান্ড্রয়েড এবং আইফোন, দুটোতেই কাজ করে।
EaseUS কেন আলাদা?
- সাপোর্টের genişতা: এটি শুধুমাত্র ভিডিও নয়, সাথে কন্টাক্ট, মেসেজ, ছবির মতো আরও অনেক কিছু রিকভার করতে পারে।
- নির্ভরযোগ্যতা: এর রিকভারি সাকসেস রেট বেশ ভালো এবং এটি ক্ষতিগ্রস্ত ফাইল পুনরুদ্ধারেও বেশ কার্যকর।
- প্রিভিউ সুবিধা: রিকভার করার আগে ফাইল দেখে নেওয়ার সুবিধা তো আছেই।
কিছু সীমাবদ্ধতা:
- এর সেরা ফিচারগুলো উপভোগ করতে হলে আপনাকে প্রিমিয়াম সংস্করণটি কিনতে হতে পারে। ফ্রি সংস্করণে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
৪. Wondershare Dr. Fone (একটি কমপ্লিট টুলকিট)
Dr. Fone শুধুমাত্র একটি ভিডিও রিকভারি টুল নয়, এটি আপনার ফোনের জন্য একটি সুইস আর্মির ছুরির মতো! ডেটা রিকভারি থেকে শুরু করে ফোন ব্যাকআপ, সিস্টেম রিপেয়ার—কী নেই এতে!
Dr. Fone এর আকর্ষণ:
- অল-ইন-ওয়ান সমাধান: ভিডিও, ছবি, মেসেজ, কল লগ, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট—সবকিছু রিকভার করার ক্ষমতা রাখে।
- উচ্চ সাকসেস রেট: ইন্ডাস্ট্রিতে এর ফাইল পুনরুদ্ধারের সাফল্য অন্যতম সেরা হিসেবে পরিচিত।
- অ্যান্ড্রয়েড ও iOS সাপোর্ট: দুটি প্ল্যাটফর্মেই সমানভাবে কার্যকর।
কিছু সীমাবদ্ধতা:
- এটি একটি প্রিমিয়াম সফটওয়্যার এবং এর দাম কিছুটা বেশি।
- সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য এর অনেক ফিচারই হয়তো অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে।
৫. Stellar Photo Recovery (পেশাদারদের পছন্দ)
যখন অন্য কোনো সফটওয়্যার কাজ করে না, তখন পেশাদাররা Stellar-এর ওপর ভরসা করেন। এর শক্তিশালী অ্যালগরিদম হার্ড ড্রাইভ, এসডি কার্ড বা যেকোনো স্টোরেজ মিডিয়া থেকে সফলভাবে ডেটা পুনরুদ্ধার করতে পারে।
Stellar কেন সেরা?
- অ্যাডভান্সড স্ক্যানিং ইঞ্জিন: এটি এতটাই শক্তিশালী যে ফরম্যাট করা ড্রাইভ থেকেও ডেটা রিকভার করতে পারে।
- সব ধরনের ফাইল ফরম্যাট: এটি প্রায় সব ধরনের ভিডিও এবং ফটো ফাইল ফরম্যাট সাপোর্ট করে। এমনকি ড্রোন বা ডিএসএলআর ক্যামেরার RAW ফাইলও রিকভার করতে পারে।
- ডুয়াল মনিটর সাপোর্ট: রিকভারি প্রক্রিয়া চলার সময় আপনি একই সাথে অন্য কাজও করতে পারবেন।
কিছু সীমাবদ্ধতা:
- এটি একটি প্রিমিয়াম সফটওয়্যার এবং এর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি।
- সাধারণ বা ছোটখাটো কাজের জন্য এটি ব্যবহার করা কিছুটা overkill হতে পারে।
এক নজরে সফটওয়্যারগুলোর তুলনা
সফটওয়্যার | প্ল্যাটফর্ম | মূল্য | ব্যবহারের সহজতা | সেরা ফিচার |
Recuva | Windows PC | ফ্রি/পেইড | খুবই সহজ | ডিপ স্ক্যান সুবিধা |
DiskDigger | Android | ফ্রি/পেইড | সহজ | রুট করা ফোনে দারুণ কার্যকর |
EaseUS MobiSaver | Android, iOS, PC | ফ্রি/পেইড | মাঝারি | বিভিন্ন ধরনের ডেটা রিকভারি |
Dr. Fone | Android, iOS, PC | পেইড | মাঝারি | অল-ইন-ওয়ান ফোন ম্যানেজমেন্ট |
Stellar | Windows, Mac | পেইড | পেশাদার | ফরম্যাট করা ড্রাইভ থেকে রিকভারি |
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্ন (FAQs)
প্রশ্ন: মোবাইল থেকে ডিলিট হওয়া ভিডিও কি সত্যি ফিরে পাওয়া সম্ভব? উত্তর: হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব। তবে এর সাফল্যের হার নির্ভর করে ভিডিওটি কতদিন আগে ডিলিট হয়েছে এবং ডিলিট হওয়ার পর আপনি ফোনটি কতটা ব্যবহার করেছেন তার ওপর। যত তাড়াতাড়ি রিকভারির চেষ্টা করবেন, সাফল্যের সম্ভাবনা তত বেশি।
প্রশ্ন: ফ্রি সফটওয়্যারগুলো কি আসলেই কাজ করে? উত্তর: হ্যাঁ, Recuva বা DiskDigger-এর মতো ফ্রি সফটওয়্যারগুলো সাধারণ রিকভারির জন্য বেশ ভালো কাজ করে। তবে অনেক পুরনো, বড় আকারের বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ফাইল পুনরুদ্ধারের জন্য পেইড সফটওয়্যারগুলো বেশি নির্ভরযোগ্য।
প্রশ্ন: ভিডিও ডিলিট হওয়ার পর আমার প্রথম কাজ কী হবে? উত্তর: প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ওই ডিভাইসটি ব্যবহার করা বন্ধ করে দেওয়া। যদি ফোন থেকে ডিলিট হয়, তাহলে ইন্টারনেট বন্ধ করুন এবং কোনো নতুন অ্যাপ বা ফাইল ডাউনলোড করা থেকে বিরত থাকুন। এতে আপনার পুরনো ডেটা ওভাররাইট হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।
শেষ কথা
ভুলবশত ভিডিও বা যেকোনো ফাইল ডিলিট হয়ে যাওয়াটা খুবই হতাশাজনক। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে, এখন আর সবকিছু হারিয়ে যায় না। সঠিক সময়ে সঠিক ডিলিট হওয়া ভিডিও ফিরে পাওয়ার সফটওয়্যার ব্যবহার করলে আপনার মূল্যবান স্মৃতিগুলো আবার ফিরে পাওয়া সম্ভব।
মনে রাখবেন, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। তাই নিয়মিত আপনার গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো ক্লাউড স্টোরেজ (যেমন: Google Photos, Google Drive) বা অন্য কোনো এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভে ব্যাকআপ রাখার অভ্যাস করুন।
আপনার কি কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে? কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করে আপনি সেরা ফল পেয়েছেন? আপনার মূল্যবান অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে কমেন্ট সেকশনে শেয়ার করুন!