জোহ্রান মামদানি: নিউ ইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম মেয়র

জোহ্রান মামদানি (Zohran Mamdani) ২০২৫ সালের নির্বাচনে নিউ ইয়র্ক সিটির ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন। তিনি শুধু শহরের প্রথম মুসলিম মেয়র নন; তিনি একই সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত, আফ্রিকা-জন্ম, এবং ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট একজন প্রার্থী, যিনি প্রচলিত রাজনীতির কাঠামো ভেঙে জনশক্তির উপর ভর করে একটি ঐতিহাসিক জয় অর্জন করেছেন।

এই আর্টিকেলে আমরা দেখতে পাব—
তিনি কে, কেন তিনি জিতলেন, এবং কীভাবে তিনি নিউ ইয়র্কের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে পরাজিত করলেন।

জোহ্রান মামদানি কে?

জোহ্রান মামদানি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯১ সালে উগান্ডার কামপালা শহরে। তার পরিবার দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত হলেও তিনি বেড়ে উঠেছেন নিউ ইয়র্কে—যে শহর পরবর্তীতে তার রাজনৈতিক পরিচয়ের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

তার বাবা মাহমুদ মামদানি একজন বিশ্বখ্যাত চিন্তাবিদ, গবেষক ও অধ্যাপক।
মা মীরা নায়ার, আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা।

বর্ণিল পরিবার, অভিবাসী জীবন এবং নিউ ইয়র্কের কঠিন বাস্তবতা—সব মিলিয়ে তার ভেতরে জন্ম নেয় সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার এক গভীর উপলব্ধি।

রাজনীতিতে আগমন

জোহ্রান মামদানি প্রথম আলোচিত হন ২০২০ সালে, যখন তিনি নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
তিনি Democratic Socialists of America (DSA)-এর সদস্য, যা তাকে প্রচলিত ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতির তুলনায় আরও সাধারণ মানুষনির্ভর পথ দেখিয়েছে।

রাজনীতিতে আসার আগে তিনি কাজ করেছেন—

  • হাউজিং কাউন্সেলর হিসেবে

  • গৃহহীন বা ভাড়া দিতে না পারা পরিবারের পাশে

  • ট্যাক্সি ড্রাইভারদের ঋণ সংকট মোকাবিলায়

এইসব কাজ তার জনপ্রিয়তা তুলেছে নিউ ইয়র্কের শ্রমজীবী ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে।

কেন জোহ্রান মামদানির জয় ঐতিহাসিক?

প্রথম মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র

নিউ ইয়র্ক একটি বহুজাতিক, বহু সংস্কৃতির শহর—কিন্তু কখনো কোনো মুসলিম ব্যক্তি এই শহরের মেয়র হননি। মামদানির জয় সেই ইতিহাসে প্রথম আলো জ্বালাল।

অ্যান্ড্রু কুওমোকে হারানো

ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনে তিনি পরাজিত করেন—

  • তিনবারের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোকে

  • যার পরিবার নিউ ইয়র্ক রাজনীতির অন্যতম শক্তিশালী পরিবার

  • যার পেছনে কাজ করছিল অর্থশালী কর্পোরেট ডোনাররা

এত বড় রাজনৈতিক ক্ষমতার বিপরীতে গ্রাসরুটস ক্যাম্পেইন—এটি নিজেই এক অভিনব ঘটনা।

অর্গানাইজড মানির বিরুদ্ধে অর্গানাইজড পিপল

মামদানির প্রচারণার মূল বার্তা ছিল—

“বড় টাকার রাজনীতি নয়, জনগণের রাজনীতি।”

এটি নিউ ইয়র্কের তরুণ, শ্রমিক, অভিবাসী ভোটারদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

সৃজনশীল প্রচারণা

তিনি প্রচারণায় ব্যবহার করেন—

  • বলিউড রেফারেন্স

  • স্প্যানিশ কনটেন্ট

  • বাংলাদেশি ভোটারদের জন্য বাংলা ভিডিও

  • মজার, রসিক ও আকর্ষণীয় রিল

এটি তরুণ ভোটারদের মধ্যে ভাইরাল হয়ে ওঠে।

ইসরায়েল–ফিলিস্তিন নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান

এটি একদিকে বিতর্ক তৈরি করলেও, অন্যদিকে অনেক ভোটারের কাছে তাকে সত্যবাদী ও সাহসী প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরে।

নিউ ইয়র্ক নির্বাচনে তার জয়ের কৌশল

১. Ranked-Choice Voting-এর সুবিধা কাজে লাগানো

নিউ ইয়র্কে প্রাইমারি নির্বাচন হয় র‍্যাঙ্কড চয়েস পদ্ধতিতে—
এখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পছন্দের ভোটও নির্ধারণ করে কারা শীর্ষে থাকবেন।

মামদানির জনপ্রিয়তা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে ছড়িয়ে থাকায় এই সিস্টেম তার জন্য ছিল বড় সুবিধা।

২. বিলিয়নিয়ারদের মোকাবিলা করে জনগণের অর্থে ক্যাম্পেইন

যেখানে প্রতিপক্ষেরা কোটি ডলার ব্যয় করেছে, সেখানে মামদানি প্রমাণ করেছেন—
জনতা যদি সাথে থাকে, টাকা জিততে পারে না।

৩. লাইভ ইভেন্ট, ডোর-টু-ডোর ক্যানভাসিং

তার ক্যাম্পেইন মডেল ছিল field-first
অর্থাৎ, অনলাইন কনটেন্ট যেমন শক্তিশালী, মাঠের লড়াইও তেমনই।

তার প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি

  • ভাড়া কমানো এবং রেন্ট ফ্রিজ

  • সাশ্রয়ী আবাসন বৃদ্ধি

  • ট্রানজিট ভাড়া কমানো

  • শ্রমজীবী মানুষের মজুরি বৃদ্ধি

  • কর্পোরেট কর বৃদ্ধি

  • অভিবাসীবান্ধব নীতি

ভোটাররা কেন তাকে বেছে নিল?

✔ তিনি অভিবাসীদের সন্তান
✔ তিনি নিউ ইয়র্কের বাস্তব সমস্যা জানেন
✔ প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে তিনি ভয় পান না
✔ সৃজনশীল, নন-ট্র্যাডিশনাল রাজনৈতিক চরিত্র
✔ তরুণ প্রজন্মের ভোট ১০০% তার দিকে গেছে

অনেকেই বলেছেন—

“তার প্রতিশ্রুতির ১০ শতাংশও পূরণ হলে নিউ ইয়র্ক বদলে যাবে।”

উপসংহার

জোহ্রান মামদানির জয় শুধু একজন মেয়রের নির্বাচন নয়; এটি একটি রাজনৈতিক বিপ্লব, সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং ভবিষ্যৎ আমেরিকান শহর-রাজনীতির রূপরেখা।
তিনি প্রমাণ করেছেন গণমানুষের শক্তি কর্পোরেট অর্থকে হারাতে পারে।

তার শপথ গ্রহণের দিন—১ জানুয়ারি ২০২৬

নিউ ইয়র্ক সিটি একটি নতুন পাতায় প্রবেশ করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top