জুলাই সনদ আসলে কী? এবং এর সনদের কাজটাই বা কী

ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি সফল গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পরই কোনো না কোনো ধরনের চার্টার বা সনদ তৈরি করা হয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের পর Declaration of the Rights, দক্ষিণ আফ্রিকায় Freedom Charter, মিশরে March Charter of the Revolution—এসব উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। বাংলাদেশেও ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এমন একটি সনদের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জুলাই সনদ কি সত্যিই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে?

জুলাই সনদ কী এবং কেন?

২০২৫ সালের ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বাংলাদেশের ২৫টি রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে। মোট ২৮টি প্রতিশ্রুতি সম্বলিত এই সনদে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক সংস্কার সংক্রান্ত বিভিন্ন অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল। এসব কমিশনের সুপারিশমালা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ৭ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। অধ্যাপক আলী রিয়াজের নেতৃত্বে দীর্ঘ আট মাসে প্রায় ৭২ দিন রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য শক্তির সঙ্গে আলোচনার পর এই সনদ চূড়ান্ত করা হয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান

জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা মতপার্থক্য রয়েছে। ৩০টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সবাই স্বাক্ষর করেনি। বিএনপি প্রথম দিকে এই সনদের প্রতি তেমন গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পক্ষে মত দেয়। তবে তারা এটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিপক্ষে।

অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এবং জাসদ স্বাক্ষর থেকে বিরত থেকেছে। তাদের অভিযোগ, সনদে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে এবং সংবিধানের মৌলিক নীতিমালায় পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে।

কী নেই জুলাই সনদে?

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদকে ‘নতুন বাংলাদেশের সূচনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও সমালোচকরা বলছেন ভিন্ন কথা। সংবিধান, নির্বাচন, বিচার ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব থাকলেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, শ্রম ও নারী অধিকার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই।

স্বাস্থ্যখাত

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন জনবান্ধব স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানা সুপারিশ করলেও তা সনদে স্থান পায়নি। ফলে প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবার সংকট আগের মতোই রয়ে গেছে।

অর্থনীতি

অর্থনৈতিক খাতের দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধে কিছুটা প্রস্তাব থাকলেও আর্থিক খাত সংস্কারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুপস্থিত। অর্থনীতিবিদরা এটিকে সনদের অন্যতম দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

শিক্ষা

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পটভূমিতে শিক্ষা বৈষম্য দূরীকরণ একটি মূল দাবি হলেও জুলাই সনদে তার কোনো প্রতিফলন নেই। শিক্ষার্থীদের মূল আকাঙ্ক্ষাই অপূর্ণ রয়ে গেছে।

শ্রম ও নারী অধিকার

দুইটি কমিশন রিপোর্ট জমা দিলেও সেগুলোর কোনো সুপারিশ সনদে স্থান পায়নি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, শ্রমিক ও নারীদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়গুলো যুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি ছিল।

বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কতটুকু?

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও এই ভোট কিভাবে হবে এবং কবে হবে তা এখনো পর্যন্ত পরিষ্কার নয়।

ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রিয়াজ বলেছেন, সংস্কার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদী এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার অন্যান্য কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে কাজ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মতো একটি তথাকথিত অরাজনৈতিক নিরপেক্ষ সরকারই যেখানে ন্যূনতম সংস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সরকার এমন সংস্কার করবে কিনা—তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

উপসংহার

দেশের জনগণ যে ধরনের সংস্কারের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, সেই ধরনের সংস্কারের বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। সবমিলিয়ে জুলাই সনদ বাংলাদেশিদের জন্য এক আড়ম্বরপূর্ণ ঘোষণা মাত্র। এতে অনেক গালভরা কথা যেমন আছে, তেমনি বৈষম্যবিরোধী এই সনদেই রয়ে গেছে বহু বৈষম্যের বীজ।

জুলাই আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া সাধারণ ছাত্র আন্দোলন কিভাবে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল—তা আমরা সবাই প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু সেই আন্দোলনের ফসল হিসেবে তৈরি জুলাই সনদ নিয়ে আমরা হয়তো আশা করতে পারি, তবে হতাশার নিশ্চয়তাও এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top