গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোন বই পড়তে হবে

তোমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ। এবার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পালা। কিন্তু হাতে ঢুকে গেল গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম। এখন মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরছে – গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোন বই পড়তে হবে?

আমি জানি, তুমি এখন হয়তো বইয়ের দোকানে গিয়ে হাজারটা বই দেখে মাথা চুলকাচ্ছ। কোনটা কিনব, কোনটা ভালো, কোনটা জরুরি – এই দ্বিধায় পড়ে গেছ। চিন্তা করো না। আজ আমি তোমাকে এমন একটা কমপ্লিট গাইড দেব যেখানে পাবে সব উত্তর। তো চলো, শুরু করা যাক।

গুচ্ছ পরীক্ষা আসলে কী? একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা

গুচ্ছ মানে হলো ১৯টি সাধারণ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একসাথে নেওয়া ভর্তি পরীক্ষা। একটা পরীক্ষা দিয়েই তুমি পেতে পারো একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। সময় বাঁচে, খরচও কমে। কিন্তু প্রতিযোগিতা? সেটা একটু বেশিই।

পরীক্ষাটি ১০০ নম্বরের MCQ পদ্ধতিতে হয়। পাস মার্ক মাত্র ৩০। শুনে সহজ মনে হচ্ছে? কিন্তু ক্যাচ হলো – প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য কাটা যাবে ০.২৫ মার্ক। তাই বুঝেশুনে উত্তর দিতে হবে।

বিজ্ঞান বিভাগের জন্য (A ইউনিট) কোন বই পড়বে?

বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে তোমার সামনে চ্যালেঞ্জটা একটু বেশি। কারণ তোমাকে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত বা জীববিজ্ঞান – এই বিষয়গুলোতে সমান দক্ষতা দেখাতে হবে।

পদার্থবিজ্ঞানের বই তালিকা

পদার্থবিজ্ঞানে গাণিতিক সমস্যা থেকে বেশি প্রশ্ন আসে। তাই শুধু থিওরি পড়লে হবে না, ম্যাথ প্র্যাক্টিস করতে হবে পাগলের মতো।

  • এইচএসসি পদার্থবিজ্ঞান পাঠ্যবই (প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র) – এটা তোমার বেসিক ফাউন্ডেশন। এই বই না পড়লে অন্য কিছুই কাজে আসবে না।
  • QNA গুচ্ছ Admission Analysis Series – Physics – বিগত বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে এই বই তৈরি। প্যাটার্ন বুঝতে চাইলে এটা মাস্ট।
  • জয়কলি পদার্থবিজ্ঞান বিচিত্রা – বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন এবং সমাধান পাবে এখানে।
  • আসপেক্ট/নেটওয়ার্ক গুচ্ছ সহায়িকা (বিজ্ঞান) – রিভিশনের জন্য পারফেক্ট।

প্রো টিপ: গতিবিদ্যা, নিউটনিয়ান বলবিদ্যা, তাপগতিবিদ্যা, তড়িৎ – এই চ্যাপ্টারগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন আসে। এখানে ফোকাস বেশি দাও।

রসায়নের বই তালিকা

রসায়ন মানেই হাজারী স্যার। এই নাম না শুনলে তোমার গুচ্ছ প্রস্তুতিই অসম্পূর্ণ।

  • হাজারী স্যারের রসায়ন বই – মূল বাইবেল বলতে পারো একে। প্রতিটি অনুশীলনীর প্রশ্ন যেন তোমার হাতের তালুর মতো চেনা হয়ে যায়।
  • QNA গুচ্ছ Admission Analysis Series – Chemistry
  • জয়কলি রসায়ন বিচিত্রা
  • রয়াল GST+ Admission Preparation Book – শেষ সময়ের প্রস্তুতির জন্য।

গুণগত রসায়ন, মৌলের পর্যায়বৃত্ত ধর্ম, জৈব যৌগ, তড়িৎ রসায়ন – এই টপিকগুলো বেশি ইম্পরট্যান্ট।

গণিতের বই তালিকা

গণিতে শর্টকাট শিখলেই হবে না, হাতে ক্যালকুলেশনের দক্ষতা লাগবে। কারণ পরীক্ষা হলে ক্যালকুলেটর নিষিদ্ধ।

  • এইচএসসি উচ্চতর গণিত পাঠ্যবই
  • QNA গুচ্ছ Admission Analysis Series – Math
  • জয়কলি গণিত বিচিত্রা

সরলরেখা, বৃত্ত, অন্তরীকরণ, যোগজীকরণ, জটিল সংখ্যা, কনিক – এই চ্যাপ্টারগুলো বেশি প্র্যাক্টিস করো।

জীববিজ্ঞানের বই তালিকা

জীববিজ্ঞান তুলনামূলক সহজ। খুব ডিপ লেভেলের প্রশ্ন আসে না।

  • এইচএসসি জীববিজ্ঞান পাঠ্যবই
  • QNA গুচ্ছ Admission Analysis Series – Biology
  • জয়কলি জীববিজ্ঞান বিচিত্রা

বেসিক লাইন, ডায়াগ্রাম, পয়েন্ট – এগুলো ভালো করে আয়ত্ত করো।

বাংলা ও ইংরেজি – যেগুলো সবার জন্য মাস্ট

বিজ্ঞান বিভাগের অনেকেই বাংলা-ইংরেজিকে হালকাভাবে নেয়। কিন্তু ভুলে যেও না, এখান থেকেও ২৫+২৫ = ৫০ মার্ক আসতে পারে।

বাংলার জন্য

  • এইচএসসি বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র বই
  • বাংলা বিচিত্রা (জয়কলি)
  • বাংলা ম্যাজিক

গুরুত্বপূর্ণ টপিক: সমাস, সন্ধি, কারক, বাগধারা, প্রকৃতি-প্রত্যয়। গদ্য ও কবিতার মূল বিষয় এবং লেখক পরিচিতি মনে রাখো।

ইংরেজির জন্য

  • এইচএসসি ইংরেজি পাঠ্যবই
  • ইংরেজি বিচিত্রা (জয়কলি)
  • Master’s English বা ইংরেজি ম্যাজিক

গুরুত্বপূর্ণ টপিক: Right form of verb, Voice, Narration, Tense, Translation, Synonyms, Antonyms.

আইসিটি – মোটামুটি ধারণা থাকলেই চলবে

আইসিটি নিয়ে বেশি টেনশন করার দরকার নেই। এইচএসসি বই এবং টেস্ট পেপার্স থেকে জ্ঞানমূলক MCQ পড়লেই হবে। সংখ্যা পদ্ধতি, লজিক গেট, HTML, C প্রোগ্রামিং, ডাটাবেজ – এই টপিকগুলো বেশি ইম্পরট্যান্ট।

মানবিক বিভাগের জন্য (B ইউনিট) কোন বই পড়বে?

মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষাটা একটু ভিন্ন প্যাটার্নের। বাংলা ৩৫, ইংরেজি ৩৫, এবং সাধারণ জ্ঞান ৩০ নম্বর।

বাংলা ও ইংরেজির বই

মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য বাংলা-ইংরেজি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। উপরে যেসব বই উল্লেখ করেছি, সেগুলোই পড়বে। তবে এর সাথে যোগ করো:

  • আসপেক্ট গুচ্ছ নলেজ – মানবিক বিভাগ

সাধারণ জ্ঞান – সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ

সাধারণ জ্ঞান মানেই অসীম জগৎ। কোথা থেকে কী আসবে, তার কোনো ঠিক নেই। তবু কিছু বই আছে যা তোমার পথ সহজ করবে।

  • মৌলিক জিকে (গাইডলাইন পাবলিকেশনস) – খুবই পপুলার এবং কার্যকর।
  • খন্দকার জিকে
  • জুবায়ের জিকে
  • গুচ্ছ ফাইনাল GK
  • দৈনিক প্রথম আলো/কালের কণ্ঠ – সাম্প্রতিক তথ্যের জন্য।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পৌরনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ভূগোল থেকেও প্রশ্ন আসে। তাই এগুলোও ইগনোর করা যাবে না।

বাণিজ্য বিভাগের জন্য (C ইউনিট) কোন বই পড়বে?

বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য হিসাববিজ্ঞান এবং ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা বিষয় থেকে প্রশ্ন আসে।

  • এইচএসসি হিসাববিজ্ঞান পাঠ্যবই – মূল বই হিসেবে এটাই যথেষ্ট।
  • এইচএসসি ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা পাঠ্যবই
  • বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নব্যাংক বই

সাজেশন ও প্রশ্নব্যাংক বই

যখন পরীক্ষা মাত্র ১-২ মাস বাকি, তখন পুরো সিলেবাস পড়া পসিবল না। এই সময় তোমার দরকার হবে:

  • QNA গুচ্ছ Admission Suggestion – টার্গেটেড সাজেশন পাবে।
  • রয়াল GST Plus Admission Preparation Book
  • নেটওয়ার্ক গুচ্ছ ভর্তি সহায়িকা
  • আসপেক্ট গুচ্ছ সহায়িকা সিরিজ
  • পানকৌড়ি বিজ্ঞানবিদ্যা

বই নির্বাচনের আগে যা মাথায় রাখবে

১. মূল পাঠ্যবই সর্বোচ্চ গুরুত্ব

কোনো সাহায্যকারী বই তোমার এইচএসসি পাঠ্যবইকে রিপ্লেস করতে পারবে না। বেসিক ধারণা পরিষ্কার করতে হলে মূল বই পড়তেই হবে। আমি দেখেছি অনেকে শুধু গাইড বই পড়ে – এটা বড় ভুল।

২. প্রশ্নব্যাংক ও Analysis বই ব্যবহার করো চালাকের মতো

বিগত বছরের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে বুঝে নাও – কোন টপিক থেকে বেশি প্রশ্ন আসে। এটা জানলে তোমার পড়ার ডিরেকশন ক্লিয়ার হবে। QNA Analysis Series এবং জয়কলি বিচিত্রা এক্ষেত্রে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

৩. সাজেশন বই শেষ সময়ের জন্য রাখো

সাজেশন বই মানেই শর্টকাট। কিন্তু এটা তোমার প্রাথমিক প্রস্তুতি হতে পারে না। যখন তুমি পুরো সিলেবাস একবার শেষ করে ফেলবে, তখন ফাইনাল রিভিশনের জন্য সাজেশন বই পড়তে পারো।

৪. সাধারণ জ্ঞানে নিয়মিত থাকো

মৌলিক জিকে এবং খন্দকার জিকে বই পড়ার পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদপত্র পড়ো। বিশেষত সম্পাদকীয়, আন্তর্জাতিক সংবাদ, এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক খবর।

৫. একসাথে অনেক বই কিনে ফেলো না

অনেকেই ভাবে – বেশি বই মানেই বেশি প্রস্তুতি। কিন্তু আসলে বেশি বই কিনে তুমি কনফিউজড হবে এবং কোনোটাই ঠিকমতো শেষ করতে পারবে না। দু-তিনটা কোয়ালিটি বই ভালোভাবে পড়ো।

কোন প্রকাশনীর বই সবচেয়ে ভালো?

এটা একটা কমন প্রশ্ন। আমার মতে:

  • জয়কলি বিষয়ভিত্তিক বিচিত্রা সিরিজ – প্রশ্নের কোয়ালিটি এবং ভ্যারাইটির জন্য বেস্ট।
  • QNA গুচ্ছ Analysis Series – অ্যানালাইসিসের জন্য এক নম্বর।
  • আসপেক্ট/নেটওয়ার্ক সহায়িকা – কমপ্যাক্ট এবং রিভিশন-ফ্রেন্ডলি।
  • রয়াল সাইন্টিফিক পাবলিকেশনস – GST Plus বইটা ভালো।
  • পানকৌড়ি বিজ্ঞানবিদ্যা – বিজ্ঞান বিভাগের জন্য।
  • গাইডলাইন পাবলিকেশনস – জিকের জন্য মৌলিক জিকে।

প্রস্তুতির কৌশল

সময়সীমা অনুযায়ী পরিকল্পনা

দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি (৬-৮ মাস): মূল পাঠ্যবই সম্পূর্ণ পড়ো। প্রতিটি অধ্যায়ের বেসিক ক্লিয়ার করো। ফর্মুলা, সূত্র, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট নোট করে রাখো।

মধ্যমেয়াদী প্রস্তুতি (৩-৫ মাস): প্রশ্নব্যাংক ও Analysis বই অনুশীলন করো। বিগত বছরের গুচ্ছ, রাবি, চবি, ঢাবি, জাবি, সাস্ট প্রশ্ন সলভ করো।

শেষ সময়ের প্রস্তুতি (১-২ মাস): সাজেশন বই, মডেল টেস্ট, রিভিশন। প্রতিদিন নিয়মিত মডেল টেস্ট দাও এবং সময় ব্যবস্থাপনা অনুশীলন করো।

বিষয়ভিত্তিক টিপস

পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত: শর্টকাট পদ্ধতি শেখো। কিন্তু মূল কনসেপ্ট না বুঝে শর্টকাট মুখস্থ করো না। হাতে ক্যালকুলেশনের স্পিড বাড়াও।

রসায়ন: হাজারী স্যারের বই যেন তোমার হাতের মুঠোয় থাকে। প্রতিটি রিঅ্যাকশন, ফর্মুলা মুখস্থ করো।

জীববিজ্ঞান: ডায়াগ্রাম প্র্যাক্টিস করো। ভিজুয়াল মেমোরি কাজে লাগাও।

বাংলা-ইংরেজি: নিয়মিত পড়ো। একদিন ছেড়ে দিলে ভুলে যাবে। প্রতিদিন ১০-১৫টা MCQ প্র্যাক্টিস করো।

সাধারণ জ্ঞান: মাসিক কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ফলো করো। দৈনিক একটা সংবাদপত্র নিয়মিত পড়ো।

নেগেটিভ মার্কিং সামলাও বুদ্ধির সাথে

প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য ০.২৫ নম্বর কাটা যাবে। তাই নিশ্চিত না হলে উত্তর না দেওয়াই ভালো। কিন্তু এটার মানে এই না যে খুব বেশি প্রশ্ন ছেড়ে দেবে। ক্যালকুলেটেড রিস্ক নিতে শেখো।

কত মার্ক পেলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স?

এটা ডিপেন্ড করে তোমার বিভাগ এবং টার্গেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। তবে একটা রাফ আইডিয়া:

  • বিজ্ঞান বিভাগ: ৬০-৭০+ মার্ক পেলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবে।
  • মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগ: ৫৫-৬৫+ মার্ক পেলে ভালো পজিশনে থাকবে।

মনে রাখবে, পাস মার্ক ৩০ হলেও সাবজেক্ট পেতে হলে তোমাকে অনেক বেশি স্কোর করতে হবে।

আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ

আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, আমি এভাবে প্রস্তুতি নিতাম:

১. প্রথম ৩ মাস: মূল পাঠ্যবই পড়া এবং বেসিক ক্লিয়ার করা।

২. পরবর্তী ২ মাস: QNA এবং জয়কলি বিচিত্রা থেকে প্রশ্ন প্র্যাক্টিস।

৩. শেষ ১ মাস: সাজেশন বই, মডেল টেস্ট, এবং রিভিশন।

তবে এটা শুধু একটা ফ্রেমওয়ার্ক। তুমি তোমার সুবিধামতো অ্যাডজাস্ট করে নাও।

শেষ কথা

গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সহজ না, কিন্তু অসম্ভবও না। সঠিক বই নির্বাচন, পরিকল্পিত প্রস্তুতি, এবং নিয়মিত অনুশীলন – এই তিনটা জিনিস তোমাকে সফল করবে।

মনে রাখবে, বই শুধু একটা টুল। আসল ম্যাজিক তোমার পরিশ্রম এবং ডেডিকেশনে। তাই নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, কনসিস্টেন্ট থাকো, এবং তোমার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য যা যা করা দরকার তাই করো।

শুভকামনা রইল তোমার সাথে। তুমি পারবে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top