ঢাকা: দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় আবার ফিরে এসেছে গণভোট শব্দটি। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের প্রস্তাব দেওয়ায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কেউ একে জনগণের সরাসরি মতামত নেওয়ার সুযোগ বলছেন, আবার কেউ আশঙ্কা করছেন এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।
গণভোট কী এবং কেন প্রয়োজন?
গণভোট হলো গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমত গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, নির্বাচনে জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে, কিন্তু গণভোটে তারা সরাসরি কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়ে মতামত দেয়।
গণভোট সাধারণত অনুষ্ঠিত হয় সংবিধান পরিবর্তন বা প্রণয়ন, অঞ্চল বিচ্ছিন্নতা, আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদন, রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তন এবং গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ন বা বাতিলের ক্ষেত্রে। এই প্রক্রিয়ায় ভোটারদের থেকে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট গ্রহণ করা হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বাংলাদেশে গণভোটের ইতিহাস
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯১ সালে সংবিধানের ধারা ১৪২-তে গণভোটের বিধান যুক্ত করা হয়। তবে শেখ হাসিনার শাসনামলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান বাতিল করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘুরে আসে চলতি বছর জুলাই মাসে। হাইকোর্ট এক রায়ে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল করে। এই ধারা অনুযায়ী, সংবিধানের নির্দিষ্ট কিছু অংশ পরিবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের মতামত নিতে পারেন।
জুলাই জাতীয় সনদ ও গণভোট প্রস্তাব
বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এই সনদ বাস্তবায়নে অবিলম্বে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে। মূল উদ্দেশ্য হলো জুলাই জাতীয় সনদ ও সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫-এর প্রতি জনগণের সম্মতি যাচাই করা।
কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রিয়াজ জানিয়েছেন, গণভোটের সময়সীমা নির্দিষ্ট নয়। সরকার চাইলে নির্বাচনের দিন বা তার আগেও এটি আয়োজন করতে পারে।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও সরকারের অবস্থান
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণভোট নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা তিন-চার দিনের মধ্যে পরিষ্কারভাবে জানা যাবে।
গণভোট: সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা
গণভোটের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, যা তাদের নিজের ভবিষ্যৎ বেছে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। তবে সমালোচকরা বলছেন, সব ভোটার সব তথ্য জানেন না বা বুঝতে পারেন না। আবার কখনো আবেগতাড়িত হয়ে ভোট দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। ফলে সিদ্ধান্ত ভুলও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণভোট কখনো কখনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতও হতে পারে। তাই গণভোটের আগে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, খোলামেলা আলোচনা এবং নিরপেক্ষ তথ্য প্রচার অত্যন্ত জরুরি।
আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান জানা গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।