তুমি কি জানো, বাংলাদেশের ৯টি সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে তোমাকে মাত্র একটি পরীক্ষা দিতে হবে? হ্যাঁ, শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই বাস্তব। কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হলো সেই সোনার টিকিট, যা তোমাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খুলে দিতে পারে।
আমি যখন প্রথম এই পরীক্ষা সম্পর্কে জানি, মনে হয়েছিল এটা কতটা সুবিধাজনক! একটা পরীক্ষা, অথচ ৯টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। কিন্তু এই সুবিধার পাশাপাশি আছে কিছু চ্যালেঞ্জও। আর সেগুলো মোকাবেলা করতে চাই সঠিক প্রস্তুতি আর স্পষ্ট ধারণা।
কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আসলে কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হলো একটি সমন্বিত ভর্তি ব্যবস্থা। ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশের ৯টি সরকারি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে এই পরীক্ষা আয়োজন করছে। তুমি একবার পরীক্ষা দিলেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হবে।
এই ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জেনে নাও:
- বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), ময়মনসিংহ
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
- শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
- সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
- পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
- চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়
- খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
- হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
- কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৫ সালের কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা
এবার আসি তোমার সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নে কবে পরীক্ষা, কীভাবে আবেদন করবে? চলো দেখি:
| বিষয় | তারিখ/তথ্য |
|---|---|
| আবেদন শুরু | UPComming.. |
| আবেদনের শেষ তারিখ | UPComming.. |
| পরীক্ষার তারিখ | UPComming.. |
| পরীক্ষার সময় | বিকাল ৩টা – ৪টা |
| আবেদন ফি | ১,২০০ টাকা |
| আসন সংখ্যা | ৩,৮৬৩টি |
আবেদন করতে হবে সম্পূর্ণভাবে অনলাইনে। ওয়েবসাইট হলো acas.edu.bd। মনে রেখো, এই ওয়েবসাইটটাই তোমার প্রধান সূত্র এখান থেকেই পাবে সব আপডেট তথ্য।
তুমি কি যোগ্য? কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার যোগ্যতা
এখানে আসলে একটা খুব সিম্পল কথা আছে। তোমাকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হতে হবে, আর জিপিএ-র ব্যাপারে একটু সচেতন থাকতে হবে।
মূল শর্তগুলো হলো:
- ২০২০/২০২১/২০২২ সালে এসএসসি/সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
- ২০২৩/২০২৪ সালে এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ
- বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস (জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত নিয়ে)
- এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় পরীক্ষায় চতুর্থ বিষয় ব্যতীত ন্যূনতম জিপিএ ৪.০০
- এসএসসি ও এইচএসসিতে সর্বমোট জিপিএ ন্যূনতম ৮.৫০
দেখো, জিপিএ-র ব্যাপারটা একটু টাইট মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তবতা। তবে হাল ছেড়ে দিও না। ২০২৫ সালে সেকেন্ড টাইম আবেদনের সুযোগও আছে—যারা ২০২৩ সালে এসএসসি মানোন্নয়ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তারাও আবেদন করতে পারবে।
পরীক্ষার মানবন্টন
এটা জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখান থেকেই তুমি বুঝবে কোন বিষয়ে বেশি জোর দিতে হবে। মোট ১০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা হবে। সময় পাবে মাত্র ১ঘণ্টা। হ্যাঁ, ১ ঘণ্টায় ১০০টা প্রশ্ন—কাজেই স্পিড লাগবে!
| বিষয় | নম্বর |
|---|---|
| ইংরেজি | ১০ |
| প্রাণিবিজ্ঞান | ১৫ |
| উদ্ভিদবিজ্ঞান | ১৫ |
| পদার্থবিজ্ঞান | ২০ |
| রসায়ন | ২০ |
| গণিত | ২০ |
নেগেটিভ মার্কিং: প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য ০.২৫ নম্বর কাটা যাবে। তাই অনুমান করে উত্তর দেওয়ার আগে দুইবার ভাবো।
পাস মার্ক: ন্যূনতম ৪০ নম্বর পেতে হবে। তবে ২০২৪-২৫ সেশনে মেধা তালিকার সর্বনিম্ন নম্বর ছিল ৪৪.৫০—মানে প্রতিযোগিতা মোটামুটি কড়া।
কোটা ব্যবস্থা
হ্যাঁ, কৃষি গুচ্ছে কোটা ব্যবস্থা আছে। যদিও শতাংশ খুব বেশি না, তবুও জেনে রাখা ভালো:
- মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটা: ৩%
- প্রতিবন্ধী কোটা: ১%
- উপজাতি/পার্বত্য অঞ্চলের/অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর কোটা: ১%
চূড়ান্ত ফলাফল কীভাবে হিসাব করা হয়?
এটা একটু ইন্টারেস্টিং। শুধু ভর্তি পরীক্ষার নম্বর দিয়েই ফলাফল হয় না। মোট ১৫০ নম্বরের ভিত্তিতে মেধা তালিকা তৈরি হয়:
- ভর্তি পরীক্ষা: ১০০ নম্বর
- এসএসসি/সমমান পরীক্ষার জিপিএ: ২৫ নম্বর
- এইচএসসি/সমমান পরীক্ষার জিপিএ: ২৫ নম্বর
তাই বলা যায়, তোমার এসএসসি-এইচএসসির ফলাফলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি
এখন আসি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে কীভাবে প্রস্তুতি নেবে?
১. পাঠ্যবই তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই ভালোভাবে পড়ো। কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সিলেবাস সম্পূর্ণভাবে এইচএসসি সিলেবাস ভিত্তিক। কোনো এক্সট্রা টপিক পড়ার দরকার নেই।
২. বিগত বছরের প্রশ্ন সলভ করো
একটা মজার ব্যাপার জানো? প্রশ্ন ও টাইপ মিলিয়ে প্রায় ৪০% বা তার বেশি রিপিট হয়! তাই গত ৫ বছরের প্রশ্ন ভালোভাবে সলভ করা মানে তুমি প্রায় অর্ধেক পথ এগিয়ে আছো।
৩. টাইম ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস
১ ঘণ্টায় ১০০টা প্রশ্ন—মানে প্রতিটা প্রশ্নের জন্য গড়ে ৩৬ সেকেন্ড। কাজেই বাসায় বসে প্র্যাকটিস করার সময় টাইমার সেট করে দাও। এতে পরীক্ষার হলে চাপ কম অনুভব করবে।
৪. গুরুত্বপূর্ণ টপিকে ফোকাস
পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন আর গণিত—এই তিনটা বিষয়ে মোট ৬০ নম্বর। কাজেই এগুলোতে বেশি সময় দাও। তবে জীববিজ্ঞানকে অবহেলা করো না, কারণ এটা তোমার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মূল ভিত্তি।
৫. নেগেটিভ মার্কিংয়ের হিসাব রাখো
যে প্রশ্নগুলো একদম জানো না, সেগুলো না দিয়ে স্কিপ করো। অনুমানে ভুল করলে ০.২৫ করে নম্বর কাটা যাবে ৪টা ভুল মানে ১ নম্বর গেল। ক্যালকুলেটেড রিস্ক নাও।
কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কতটি আসন?
এটা জানা খুব জরুরি, কারণ আসন সংখ্যা দেখে তুমি বুঝবে প্রতিযোগিতা কেমন হতে পারে।
| বিশ্ববিদ্যালয় | আসন সংখ্যা |
|---|---|
| বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ১,১১৬ |
| শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ৭০৫ |
| সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ৫৮০ |
| বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ৪৩৫ |
| পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় | ৪২৩ |
| চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় | ২৭৫ |
| খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ১৫০ |
| হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ৯৯ |
| কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় | ৮০ |
মোট ৩,৮৬৩টি আসনের জন্য লাখের বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। প্রতিযোগিতা কড়া কিন্তু অসম্ভব না।
আবেদন প্রক্রিয়া
চলো দেখি কীভাবে আবেদন করবে:
ধাপ ১: acas.edu.bd ওয়েবসাইটে যাও
ধাপ ২: “আবেদন করুন” বাটনে ক্লিক করো
ধাপ ৩: প্রয়োজনীয় তথ্য পূরণ করো (এসএসসি, এইচএসসি রোল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর)
ধাপ ৪: তোমার ছবি আপলোড করো (নির্দিষ্ট সাইজ অনুযায়ী)
ধাপ ৫: আবেদন ফি পেমেন্ট করো (১,২০০ টাকা—মোবাইল ব্যাংকিং/কার্ড)
ধাপ ৬: এডমিট কার্ড ডাউনলোড করো (পরীক্ষার আগে)
মনে রেখো, আবেদন শেষ হওয়ার পর সব তথ্য একবার চেক করে নাও। ভুল হলে পরে সংশোধনের সুযোগ নাও পেতে পারো।
পরীক্ষার দিন: কী কী মনে রাখবে?
পরীক্ষার দিন একটু নার্ভাস লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু জিনিস মাথায় রাখলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে:
- সময়মতো পৌঁছাও: পরীক্ষা শুরুর অন্তত ৩০ মিনিট আগে সেন্টারে থাকার চেষ্টা করো
- এডমিট কার্ড ও আইডি কার্ড: এগুলো ছাড়া তোমাকে ঢুকতে দেবে না
- ক্যালকুলেটর নয়: ক্যালকুলেটর ব্যবহার করা যাবে না, তাই মানসিক হিসাব তোমাকেই করতে হবে
- নীল/কালো বলপেন: ওএমআর শিট পূরণের জন্য
ফলাফল প্রকাশ ও ভর্তি প্রক্রিয়া
পরীক্ষার পর সবচেয়ে উত্তেজনার সময় হলো ফলাফলের অপেক্ষা। সাধারণত পরীক্ষার ১-২ সপ্তাহের মধ্যে মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয়। ২০২৪-২৫ সেশনে ৩,৮৬৩ জন শিক্ষার্থী মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছিল।
ফলাফল প্রকাশের পর acas.edu.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে তুমি দেখতে পারবে তুমি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছ। এরপর শুরু হবে ভর্তি প্রক্রিয়া। প্রথম মাইগ্রেশনে তোমার পছন্দ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় বরাদ্দ দেওয়া হবে।
মনে রেখো: অপেক্ষমান তালিকাও আছে। প্রথমবারে না পেলেও হাল ছেড়ো না, পরবর্তী মাইগ্রেশনে সুযোগ পেতে পারো।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবিধা কী?
এই প্রশ্নটা অনেকেই করে। কেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো? আমি বলবো, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু কৃষি নিয়ে পড়ায় না। এখানে আছে:
- এগ্রিকালচার সাইন্স: ফসল উৎপাদন, মৃত্তিকা বিজ্ঞান
- ভেটেরিনারি সাইন্স: পশুচিকিৎসা
- ফিশারিজ: মৎস্য বিজ্ঞান
- ফুড টেকনোলজি: খাদ্য প্রযুক্তি
- এগ্রিবিজনেস: কৃষি ব্যবসা ব্যবস্থাপনা
- জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং: আধুনিক প্রযুক্তি
চাকরির বাজারও বেশ ভালো। সরকারি চাকরি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সব জায়গায় চাহিদা আছে।
সাধারণ ভুল যেগুলো এড়িয়ে চলবে
আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই ভুলগুলো করো না:
১. শেষ মুহূর্তে আবেদন: নেটওয়ার্ক সমস্যা বা অন্য কোনো ঝামেলা হতে পারে। তাই আগে আগে আবেদন করে ফেলো।
২. ছবির সাইজ নিয়ে সমস্যা: আবেদনের সময় নির্দিষ্ট সাইজের ছবি আপলোড করতে হয়। আগে থেকে ঠিক সাইজের ছবি রেডি রাখো।
৩. নেগেটিভ মার্কিং ভুলে যাওয়া: অনেকে পরীক্ষার হলে উত্তেজনায় সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলে। যা জানো না, সেটা স্কিপ করো।
৪. সময় ব্যবস্থাপনা: কঠিন প্রশ্নে আটকে থেকে সময় নষ্ট করো না। সহজগুলো আগে করো।
চূড়ান্ত কথা
কৃষি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা একটা বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু সঠিক প্রস্তুতি আর আত্মবিশ্বাস থাকলে এটা জয় করা কঠিন কিছু না। মনে রাখবে, তুমি শুধু একটা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো না তুমি তোমার ভবিষ্যতের জন্য একটা ভিত্তি তৈরি করছো।
আমি দেখেছি অনেক শিক্ষার্থী চিন্তায় থাকে “আমার হবে তো?” হবে, নিশ্চয়ই হবে। শুধু নিয়মিত পড়াশোনা করো, বিগত বছরের প্রশ্ন সলভ করো আর নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো।