এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের আন্দোলন ২০২৫

আপনি যদি গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার খবর অনুসরণ করছেন, তাহলে নিশ্চিত জানেন যে কিছু একটা বড় ঘটছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা রাস্তায় নেমেছেন তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং ন্যায্য বেতন-ভাতার জন্য। এটি শুধুমাত্র একটি আন্দোলন নয় এটি একটি সংগ্রাম যা প্রতিফলিত করে শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের বৈষম্য ও অবহেলা।

কিন্তু আপনি কি জানেন এই আন্দোলনের পেছনের গল্প কী? কেন তারা এত ক্ষুব্ধ? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এটি আপনার এবং আপনার পরিবারকে কীভাবে প্রভাবিত করছে? চলুন, গভীরে ডুব দিই এই জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।

এমপিও কী?

আমরা শুরু করি মৌলিক বিষয় দিয়ে। এমপিও মানে “Monthly Paid Order”। সরল কথায় বলতে গেলে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা হলেন বেসরকারি স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসায় কর্মরত যারা সরকারি তহবিল থেকে বেতন পান। তবে এটি সম্পূর্ণ সরকারি চাকরি নয় এটি একটি মাঝামাঝি ব্যবস্থা।

এমপিও ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল একটি মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে: শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং সকল শিক্ষার্থীকে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করা। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে? আমরা আসছি সেই অংশে।

তিনটি দাবি যা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা যে তিনটি মূল দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, সেগুলো হল:

১. বাড়িভাড়া ভাতা: ২০ শতাংশ বৃদ্ধি (সর্বনিম্ন ৩,০০০ টাকা)

বর্তমানে তারা পান মাত্র ১,০০০ টাকা বা মূল বেতনের কিছু অংশ। শিক্ষকরা বলছেন, ঢাকায় একটি ছোট্ট বাড়িও এত দামে পাওয়া যায় না। মূল বেতনের ২০ শতাংশ মানে? ধরুন একজন শিক্ষকের মূল বেতন ১৫,০০০ টাকা। তাহলে তিনি পাবেন ৩,০০০ টাকা বাড়ি ভাড়া। এটি অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত, তাই না?

২. চিকিৎসা ভাতা: ১,৫০০ টাকা (বর্তমানে মাত্র ৫০০ টাকা)

একজন শিক্ষকের চিকিৎসা খরচ কী শুধু ৫০০ টাকায় সীমাবদ্ধ থাকবে? আজকের যুগে একটি ডাক্তারের সাধারণ পরামর্শ খরচই অনেক সময় ৫০০ টাকার বেশি। তাই ১,৫০০ টাকা একটি আরও যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ।

৩. উৎসব ভাতা: কর্মচারীদের জন্য ৭৫ শতাংশ

কর্মচারীরা বর্তমানে পান মূল বেতনের মাত্র ৫০ শতাংশ উৎসব ভাতা। শিক্ষকরা ৫০ শতাংশ এবং কর্মচারীরা পান তারও কম। তারা চায় উভয়ে সমান সুবিধা।

একজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কত পান?

আপনি যদি ভাবছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আসলে কত বেতন পান, এখানে একটি বাস্তব উদাহরণ:

মূল বেতন ১২,৫০০ টাকা বাড়িভাড়া ভাতা ১,০০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা বিশেষ সুবিধা ১,৮৭৫ টাকা মোট (কর্তন আগে) ১৫,৮৭৫ টাকা কল্যাণ অনুদান কর্তন (১০%)-১,২৫০ টাকা হাতে পাওয়া অর্থ ১৪,৬২৫ টাকা

দেখুন, ঢাকায় একটি মোটামুটি থাকার জায়গা ভাড়া নিলে অর্ধেক বেতন চলে যায়। বাকিটা দিয়ে খাওয়া, পরিবহন, সন্তানের পড়াশোনা এসব কিছু সামলাতে হয়। এখন বুঝতে পারছেন কেন তারা ক্ষুব্ধ?

আন্দোলনে কী কী হয়েছে?

গত কয়েক সপ্তাহে অনেক কিছু ঘটেছে। একটি সময়সূচী দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার করে দিচ্ছি:

১২ অক্টোবর: আন্দোলন শুরু হয় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে। শিক্ষকরা নিয়ে আসেন তাদের তিনদফা দাবি।

১৩ অক্টোবর: কর্মবিরতি শুরু হয় সারাদেশের সব এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারছে না।

১৬-১৯ অক্টোবর: শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্থানান্তরিত হন। শুরু হয় অনশন কর্মসূচি। থালা-বাটি নিয়ে ভুখা মিছিল বের হয়।

১৯ অক্টোবর: অর্থ বিভাগ ৫ শতাংশ বাড়িভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব করে। শিক্ষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেন।

২০ অক্টোবর: শিক্ষকরা ঘোষণা দেন আমরণ অনশন করবেন। শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন না যতক্ষণ না তাদের সব দাবি পূরণ হয়।

প্রশ্ন ও উত্তর

প্রশ্ন ১: এমপিও শিক্ষকরা কেন জাতীয়করণ চান?

সরল উত্তর: তারা চান সরকারি শিক্ষকদের মতো একই সুবিধা। এখন তারা সরকারি অর্থে চলে কিন্তু সরকারি সুবিধা পায় না। এটি তাদের কাছে অত্যন্ত বৈষম্যপূর্ণ এবং সত্যিই তা।

প্রশ্ন ২: সরকার এত অনমনীয় কেন?

অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা একটি কারণ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি করা যায়।

প্রশ্ন ৩: এই আন্দোলন শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করছে কীভাবে?

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ক্লাস থেকে দূরে থেকেছে। পরীক্ষার প্রস্তুতি পিছিয়ে পড়েছে। এটি একটি সিরিয়াস সমস্যা এবং সবার জন্য কষ্টকর।

প্রশ্ন ৪: সমাধান কী হতে পারে?

দুই পক্ষের মধ্যে আরও কার্যকর আলোচনা প্রয়োজন। সরকারকে শিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে এবং শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি শুনতে হবে। একটি মধ্যপন্থা খুঁজে পাওয়া সবার স্বার্থে।

প্রশ্ন ৫: আমরা কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

সচেতনতা ছড়িয়ে দিন। এই বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করুন। শিক্ষকদের অবদানকে স্বীকৃতি দিন এবং একটি ন্যায্য সমাধানের জন্য প্রার্থনা করুন।

প্রশ্ন ৬: পাঁচ শতাংশ বাড়িভাড়া কেন যথেষ্ট নয়?

শিক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে ৫ শতাংশেই ৫৬ শতাংশ শিক্ষক ১২ শতাংশের বেশি পাবেন। কিন্তু শিক্ষকরা বলেন, তারা ন্যায্য অংশ চান, শুধু “বেশি” নয়।

প্রশ্ন ৭: সরকারি শিক্ষকরা কী পান?

সরকারি শিক্ষকরা পান মূল বেতনের ৪৫% বাড়িভাড়া, ২,০০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং অনেক অন্যান্য সুবিধা। তুলনায় এমপিও শিক্ষকরা খুবই কম পান।

প্রশ্ন ৮: এমপিও শিক্ষকদের সংখ্যা কত?

লক্ষাধিক এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারী কাজ করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। ২০১৯ সালে ২,৭৩৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল।

প্রশ্ন ৯: এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?

এটি শিক্ষা খাতে অসমতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আন্দোলন হতে চলেছে। এর ফলাফল শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

প্রশ্ন ১০: ভবিষ্যতে কী হবে?

এটি নির্ভর করবে সরকার এবং সিভিল সমাজের সিদ্ধান্তের উপর। যদি সমঝোতা সম্ভব হয়, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

বৃহত্তর প্রেক্ষাপট

আপনি যদি মনে করেন এটি শুধু বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য একটি আন্দোলন, তাহলে আপনি ভুল বুঝেছেন। এর পেছনে রয়েছে গভীর অর্থনৈতিক ন্যায়বোধ এবং পেশাদার মর্যাদার প্রশ্ন।

যখন একজন শিক্ষক গত কয়েক বছর ধরে বাড়ি ভাড়ার টানাটানিতে পড়ে থাকেন, যখন তিনি সন্তানের হাসপাতালে ভর্তির খরচ দিতে পারেন না, যখন তিনি উৎসব ভাতা দিয়ে পরিবারকে আনন্দ দিতে পারেন না তখন তিনি কীভাবে ক্লাসে যান এবং অনুপ্রেরণা নিয়ে পড়ান? এটি একটি মানবিক প্রশ্ন, শুধু অর্থনৈতিক নয়।

শিক্ষকরা সমাজের স্তম্ভ। তারা জাতির ভবিষ্যৎ তৈরি করেন। তাদের ন্যায্য মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব।

সমাধান কোথায়?

আমরা বিশ্বাস করি একটি সমাধান সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন:

  • সরকারের শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি
  • শিক্ষক সংগঠনগুলোর সাথে খোলা এবং সৎ সংলাপ
  • দেরিহীন সিদ্ধান্ত এবং প্রজ্ঞাপন জারি
  • সিভিল সমাজ ও মিডিয়ার সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক ভূমিকা

শেষ কথা

শিক্ষকদের এই আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আপনার পরিবারের সদস্য, বন্ধুবান্ধবদের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলুন। সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করুন। সরকারের কাছে চাপ প্রয়োগ করুন যেন তারা দ্রুত একটি ন্যায্য সমাধান আনে।

প্রতিটি শিক্ষক আপনার সন্তানকে শিক্ষিত করতে অবদান রাখছেন। তাদের প্রাপ্য সম্মান এবং সুবিধা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।

এই আন্দোলনের সফল সমাধান শুধুমাত্র শিক্ষকদের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি ভালো বার্তা বহন করবে যে ন্যায্যতা এবং সততা এখনও মূল্যবান।

সূত্র: বিভিন্ন বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যম এবং অফিসিয়াল নোটিস, অক্টোবর ২০২৫

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top